দেশী তাঁত সুতি কাপড় ঐতিহ্য আধুনিকতার শৈল্পিক সমন্বয় by মোরসালিন মিজান

আজিজ সুপার মার্কেটে রুচিশীল পোশাক কেনাকাটা চরিত্রের দিক থেকে একটু আলাদাই বটে আজিজ মার্কেট। নানা কারণে এটি বিখ্যাত। প্রথমে বইয়ের জন্য। কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের আড্ডার জন্য। পরে নাটক সিনেমার জন্য। আর এখন এটি বিখ্যাত দেশীয় পোশাকের জন্য। আজিজ মার্কেটের পোশাক ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য অংশ শিল্পী।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে পাস করে এ ব্যবসায় এসেছেন তাঁরা। ব্যবসার সঙ্গে শিল্পকে চমৎকারভাবে যুক্ত করেছেন। অন্যরা শিল্পী না হলেও শৌখিন। শিল্পবোধ আছে। তাঁদের তৈরি পোশাকে সে শিল্পবোধ স্পষ্ট। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, হিন্দী সিরিয়ালের নায়িকাদের পোশাক যখন বাজার একরকম দখলে নিয়েছে তখন কেবল বাংলাদেশটাকে নিয়ে আছে আজিজ মার্কেট। এটি কম বড় কথা নয়। এখানে দেশী তাঁত, সুতি কাপড় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে ঐতিহ্য আর আধুনিকতায়। সাধ ও সাধ্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। ফলে উৎসবপ্রিয় বাঙালীর মন সারা বছর ভরিয়ে রাখে আজিজ মার্কেট। যে কোন পার্বণে রুচিশীল ক্রেতারা একবার এখানে ঢুঁ না মেরে পারেন না। আর এখন তো ঈদের কেনাকাটা। সঙ্গত কারণেই ভিড় বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। দিন রাত চলছে বেচাকেনা।
শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় উৎসবের আমেজ। ফ্লোরগুলো চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। মার্কেটের একাধিক গেট দিয়ে দলবেধে প্রবেশ করছেন ক্রেতারা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন। নিচে নামছেন। তিনটি ফ্লোর ঘুরে সংগ্রহ করছেন পছন্দের পোশাক। আজিজে মোট দোকান আছে ২৩০টি। অনেক ফ্যাশন হাউসের একাধিক শোরুম। সকলেই প্রস্তুত। ঈদের সব ডিজাইন শোরুমে ওঠানো হয়ে গেছে। পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, শাড়ি সবই নতুন। বিভিন্ন ডিজাইনের। আছে টি শার্ট, ফতুয়াও।
আজিজ মার্কেট যেহেতু প্রথমেই বলতে হয় ‘নিত্য উপহার’র কথা। এটি দিয়ে আজিজ মার্কেটে পোশাকের বাজার চালু হয়েছিল। বর্তমানে এর চারটি শোরুম। একটি গ্যালারি। সবটাতেই ঈদের কালেকশন। দেশী মোটিফের পাঞ্জাবি, বাহারি থ্রী-পিস আর শাড়ি দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। বাচ্চাদের জন্যও আছে চমৎকার সংগ্রহ। পোশাক তৈরির খরচের সঙ্গে যুক্ত ‘নিত্য উপহার’ নামটি। ফলে পোশাকের দাম খুব কম নয়। তবে খুব বেশিÑ তাও বলা যাবে না। ঈদের কেনাকাটায় তাই ফ্যাশন হাউসটি অনেকের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে। প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে আছে দেশাল। এরও সুনাম বেশ। মালিক শিল্পী কনক আদিত্য। বলতেই হবে, খুব ক্রিয়েটিভ মানুষ। শিল্প সাধনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাটাও ভাল ধরতে পেরেছেন। তাই দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে নাম। এখন অন্যান্য পার্বণের মতো ঈদেও বিশেষ চাহিদা দেশালের। এর একাধিক শোরুম ঘুরে দেখা গেল, নান্দনিকতার ছোঁয়া। সব বয়সীদের জন্য পোশাক আছে। বিশেষত মেয়েদের। তরুণীদের বিশাল একটি অংশ দেশাল টার্গেট করেই মার্কেটে আসে বলে জানা যায়। দেশালের পাঞ্জাবি ফতুয়াগুলো সাদামাটা কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দামও অত না। সব মিলিয়ে মনের আনন্দে কেনাকাটা করার জায়গা। আরেক শিল্পী অভিজিৎ চৌধুরী। তাঁর ফ্যাশন হাউসের নাম তারা মার্কা। এখানে স্বতন্ত্র ডিজাইন। ক্রেতাদের ভিড়ও বেশি। আজিজ মার্কেটের উল্লেখযোগ্য আরেকটি ফ্যাশন হাউস কাপড়-ই-বাংলা। এটি প্রচারে অত আসে না। তবে পোশাকের গুণ বিচারে অনেক এগিয়ে। মেয়েদের থ্রী-পিস, ফতুয়া আর ছেলেদের পাঞ্জাবি তৈরিতে ভাল সুনাম আছে। পুরো মার্কেটে এর চারটি শোরুম। বড় শোরুমটি দ্বিতীয় তলায়। ভাল ডিসপ্লে এখানে। দেখার ভাল সুযোগ আছে। খুঁটিয়ে দেখতে পারলে চোখে পড়বে হরেক রঙের ওড়না থেকে শুরু করে রুমাল পর্যন্ত। অন্য শোরুম থেকে জামা কিনে এখানে এসে রং মিলিয়ে ওড়না কিনতে দেখা যায় কোন কোন তরুণীকে। ফ্যাশন হাউস আবির্ভাব আবার শুধু ছেলেদের জন্য। এখানে শার্ট, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট মুখ্য। অবশ্য আজিজ মার্কেটের অধিকাংশ শোরুমেই প্রধান বিক্রি টি- শার্ট। সারা বছরই এগুলো বিক্রি হয়। ঈদের কেনাকাটায় এসেও টি-শার্ট কিনে নিতে অনেকে ভুল করছেন না। এসব বিবেচনা থেকেই হয়ত অনেকে টি-শার্ট দিয়ে শোরুম সাজিয়েছেন। ফ্যাশন হাউস ঢাকঢোল এ ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে। তৃতীয় তলার একটি শোরুম টি-শার্ট দিয়ে সাজিয়েছে তারা। স্বপ্নবাজ নামের ফ্যাশন হাউসের মালিকের কারণে বিখ্যাত। মালিক জনপ্রিয় গায়ক জয়। এই গায়কের দোকানেও টি-শার্ট বেশি। টিম ওয়ার্কের শোরুমটি আবার এক সাংবাদিকের। নাম খন্দকার সোহেল। তিনিও পসরা সাজিয়েছেন টি-শার্টের। অল্প ডিজাইন। তবে সব টি-শার্টে রুচির ছাপ। এর বাইরে ঈদে ঘর সাজানোর বিভিন্ন শোপিস পাওয়া যাচ্ছে এখানে। পোশাকের পাশাপাশি ‘বিসর্গ’, ‘অতঃপর’সহ কয়েকটি ফ্যাশন হাউসে পাওয়া যাচ্ছে মাটির গহনাও। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে এসব শোরুম থেকে গহনা কিনতেও দেখা যায় মেয়েদের।
এদিকে মার্কেট জমে ওঠার পর আজিজে এসে দোকান নিয়েছে কে-ক্রাফট, সাদা কালো, বিবিয়ানাসহ বেশ কিছু নামী দামী ব্র্যান্ড। অন্য অনেক শোরুমের চেয়ে এসবে বিক্রি অনেক বেশি। ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। কখনও কখনও মনে হয়, পোশাক কেনার পাশাপাশি অনেকে ব্র্যান্ড কিনছেন দাম দিয়ে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিক্রি ভাল এ কথা কিছুতেই স্বীকার করতে চান না বিক্রেতারা। জিজ্ঞেস করলে কখনও মুচকি হাসেন। কখনও পাথর চোখে তাকান। একই নিয়মে কাপড়-ই-বাংলার স্বত্বাধিকারী বিথুন বললেন, সত্যি এখনও বিক্রি ভাল না। আমরা ঈদ উপলক্ষে প্রচুর ইনভেস্ট করেছি। সে তুলনায় ক্রেতা কম। যুক্তিও দেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। বললেন, এবার শেয়ার মার্কেট ধসের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য সহসাই অবস্থা বদলে যাবে বলে মনে করেন আবির্ভাবের নন্দন কুমার। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এখনও অনেকে পরখ করায় ব্যস্ত। এ কারণেই বিক্রি অত নেই। কয়েক দিন গেলে বিক্রি বেড়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি। তাঁর কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় কোন কোন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে। তাঁদেরই একজন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল আল মামুন। অনেক্ষণ ধরে মার্কেটে ঘুরছিলেন তিনি। কেনা হয়েছে? জানতে চাইলে বললেন, না, পছন্দ হচ্ছে না। এত এত পোশাক তবুও পছন্দ হচ্ছে না? এবার তিনি বলেন, আসলে আরও একটু দেখতে চাই। পরে কিনব।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিক্রি কম হওয়ার পরও বর্তমানে আজিজ মার্কেটে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হচ্ছে। দেশী পোশাকের এই কদর সত্যিই আশাবাদী হওয়ার মতো। অবশ্য একটি আশঙ্কাও আছে। মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, আজিজে অনেক বারোয়ারি ব্যবসায়ীরাও ঢুকে পড়েছেন। এদের নিজস্ব পোশাক নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে পোশাক সংগ্রহ করে নিজেদের নামে বিক্রি করছেন। এর ফলে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশীয় ঐতিহ্যের মার্কেটটি তার নিজস্বতা ধরে রাখতে পারবে না। আর তা হলে দারুণ ক্ষতির মুখে পড়বে দেশীয় পোশাকের বাজার। এ ব্যাপারে এখনই সকলকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সচেতন ক্রেতারা।

No comments

Powered by Blogger.