আওয়ামী লীগের জন্য বিপদ সংকেত-শতাধিক আসনে বিদ্রোহের আশঙ্কা-ভয় সংস্কারবাদীদের নিয়েও by আবদুল্লাহ আল ফারুক ও পাভেল হায়দার চৌধুরী

আগামী নির্বাচনে শতাধিক সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হবে আওয়ামী লীগ। নিজ দলের নেতারাই এসব সংসদীয় আসনে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। আসনগুলোতে বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় নেতারা দ্বিমুখী, আবার কোথাও ত্রিমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। মূলত ভাগাভাগি, প্রভাব বিস্তার, দলের ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন- এসব কারণেই এ রকম বিরোধ তৈরি হয়েছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সংস্কারবাদী হিসেবে যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি কিংবা নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখা হয়েছে- এমন অনেকেই এখন এলাকায় অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরকারি এজেন্সি, দলীয় টিম ও সংস্কৃতিসেবীসহ বিভিন্ন স্তরের লোকজন দিয়ে সারা দেশে পরিচালিত এক অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে আওয়ামী লীগের দাবি, এসব সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব দ্বন্দ্ব-কলহ মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত জুন মাসে সংসদীয় দলের সভায় দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, 'আমি জরিপ করছি। সবাই সাবধান হয়ে যান। সবার কার্যকলাপ আমার কাছে ফাইল করা আছে।' এ সময় তিনি জানান, ৩০টি সংসদীয় আসনের অবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ৩০টি ভালোও নয়, খারাপও নয়। এই ৬০টি আসনের অবস্থা ভালো করতে সংসদ সদস্যদের প্রতি নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে নিজ দলের নির্বাচিত সব সংসদ সদস্যকে স্ব-স্ব নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াতের নির্দেশও দেন তিনি।
অনেক সংসদীয় আসনে দলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি, দলীয় ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকের অংশগ্রহণে সারা দেশে জরিপ চলছে। জরিপে বহুমুখী সমস্যার কথা উঠে আসছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতিকারের ব্যবস্থাও নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কাউকে বুঝিয়ে অথবা কাউকে ধমক দিয়ে সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখছেন। তিনি বলেন, যেসব এলাকায় দলীয় নেতারাই দলীয় নেতাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তৃণমূলের সঙ্গে মতবিনিময় করে শেখ হাসিনা তা মীমাংসা করছেন। যেসব এলাকায় মীমাংসা হচ্ছে না সেখানে সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দলীয় নেতাদের মুখোমুখি অবস্থানসহ বহুমুখী এসব সংকট সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে দুর্বল থেকে দুর্বলতম করে ফেলছে। নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্ব বন্ধ না হলে আগামী নির্বাচনে জয়ের মুখ দেখা কঠিন হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি এমন রূপ নিচ্ছে যে, স্থানীয় নেতারা তো বটেই, ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতারাও বিব্রত বোধ করছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে চট্টগ্রাম-৯ আসনের এমপি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমিন, এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসি, আবদুল লতিফ ও আজম নাছির উদ্দিনের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের মতবিনিময় এবং মহাসমাবেশ উপলক্ষে বিরোধ কিছুটা মিটলেও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা সম্ভব হয়নি এখনো।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি সারাহ বেগম কবরী ও সাবেক এমপি শামীম ওসমানের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপের পরও এ দ্বন্দ্ব মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে সাবেক এমপি ইমদাদুল হক ভুঁইয়ার বিরোধে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও জড়িয়ে পড়েছেন। কুমিল্লা-৬ আসনের প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট আফজল খান এবং আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার একসঙ্গে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচনের পর আবারও বাহার-আফজল দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
পটুয়াখালী-৩ আসনে তিনবার নির্বাচিত এমপি আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনকে সংস্কারবাদী হিসেবে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। তাঁর বদলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পান ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা রনি। সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আ খ ম জাহাঙ্গীর ছাড়াও স্থানীয় নেতারা, এমনকি উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে রনির সংকট এখন প্রকাশ্য।
বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনের এমপি মনিরুল ইসলাম মণি ও বানারীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম ফারুকের বিরোধ নিয়ে এখন দ্বিধাবিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। বরিশাল-৩ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। গত তিন বছর এলাকার রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানা গেছে।
নেত্রকোনা-১ আসনের এমপি মোশতাক আহমদ রুহীর সঙ্গে সাবেক এমপি জালালউদ্দীন তালুকদারের বিরোধ মারাত্মক। জালালউদ্দীন তালুকদার শুরু থেকেই রুহীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে আছেন। নেত্রকোনা-৩ আসনের এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশীর কর্মকাণ্ড নিয়ে এলাকা তো অবশ্যই, কেন্দ্র পর্যন্ত বিরক্ত। এসব নিয়ে সাবেক ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের সঙ্গে বিরোধ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। যশোর-৩ আসনের সাবেক এমপি আলী রেজা রাজু, বর্তমান এমপি খালেদুর রহমান টিটো ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব প্রায়ই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির সঙ্গে উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরীর বিরোধ এখন প্রকাশ্য। বরগুনা-১ আসনের এমপি ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে সাবেক এমপি দেলোয়ার হোসেনের কোন্দল চরমে। শুধু তাই নয়, পিরোজপুর-২ আসনের এমপি মোহাম্মদ শাহ আলম স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না বলে সম্প্রতি স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন।
রংপুর-৪ আসনের এমপি টিপু মুন্সি রাস্তাঘাট উদ্বোধন না থাকলে নির্বাচনী এলাকায় যান না। ফলে তিনি অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। রংপুর-৫ আসনের এমপি আশিকুর রহমানও রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট উদ্বোধন ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় যান না বলে অভিযোগ করা হয়েছে কেন্দ্রের কাছে। সিলেট-৫ আসনের এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদার গত বছর সব মিলিয়ে তিন-চারবার নির্বাচনী এলাকায় পা রাখলেও বর্তমানে তিনি এলাকায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
গাইবান্ধা-৫ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার বিরুদ্ধে গত সাড়ে তিন বছরে অনেকবার বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান পুটু ও ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আকবর হোসেন সরকার।
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি ছোলায়মান হক জোয়ার্দারের সঙ্গে জেলার সাবেক সভাপতি ও বহিষ্কৃত নেতা হাসান কাদের ধনুর বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলী আজগর টগরের সঙ্গে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তিনি এলাকায় যান না। ঢাকাতে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও রাজশাহী-২ আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা, রাজশাহী-৬ আসনের শাহরিয়ার আলম, যশোর-২ আসনের মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ এবং যশোর-৬ আসনের শেখ আবদুল ওহাব, ময়মনসিংহ-১০ আসনের গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, পিরোজপুর-৩ আসনের ডা. আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আবদুল ওদুদ, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য জাকির হোসেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বলে জরিপে ধরা পড়েছে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার এমপি খালেদ বাবুর সঙ্গে পৌর মেয়র আবদুল হাইয়ের বিরোধ এখন প্রকাশ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জরিপ পরিচালনাকারী এক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে বলেছেন, আ খ ম জাহাঙ্গীরের মতো মাহমুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, আখতারুজ্জামান, সুলতান মো. মনসুর আহমদ প্রমুখ নেতাকে সংস্কারবাদী হিসেবে গত নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাঁরা এখন এলাকায় অথবা কেন্দ্রে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও আছেন, জরিপকালে যাঁদের নির্বাচনী প্রস্তুতি আছে বলেও মনে হয়নি।
ওই ব্যক্তি আরো জানান, এ ধরনের বিদ্রোহী প্রার্থী সামলানো না গেলে বা দ্বন্দ্ব মেটানো না গেলে অন্তত ১০০ আসনে আওয়ামী লীগকে মাশুল গুনতে হবে।
দলের মধ্যে নানাবিধ সমস্যা অনুসন্ধানের বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা না বলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ বড় দল। ছোট-বড় কিছু সমস্যা থাকবেই। এগুলো মাথায় রেখে আওয়ামী লীগ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তিনি বলেন, এরই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেকটি সাংগঠনিক জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শুরু করেছেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনী আসনগুলোর সঠিক চিত্র ফুটে উঠছে। শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.