রাজধানীজুড়ে রিক্সার নৈরাজ্য, যত্রতত্র দাঁড়ানো, আইন মানে না ॥ বেপরোয়া চলাচল ৩ -তালিকাভুক্ত ৭৯ হাজার, বাস্তবে সাত লাখ by রাজন ভট্টাচার্য

নিয়ন্ত্রণহীন রাজধানীর রিক্সা। লাইসেন্স না থাকা, ইচ্ছামতো চলাচলসহ পার্কিং, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কোন কিছুতেই জবাবদিহিতা নেই। এক কথায় বলতে গেলে বেপরোয়া এই পরিবহনের চালকরা। রাজধানীতে তালিকাভুক্ত রিক্সার সংখ্যা সাড়ে ৭৯ হাজার। ডিসিসিসহ বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বলা হচ্ছে প্রায় সাত লাখ।


অথচ বিগত প্রায় ১০ বছর রিক্সার লাইসেন্স বন্ধ রেখেছে সিটি কর্পোরেশন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বৈধ লাইসেন্সের নম্বর প্লেট ব্যবহার করে অবৈধভাবে চলছে প্রায় ৫০টি রিক্সা। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অনেকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ রিক্সা আর প্রাইভেট কার।
দিনে রাজধানীতে অন্তত যোগ হচ্ছে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ জন পর্যন্ত নতুন চালক। দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া হাঁকানো হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। অর্থাৎ রিক্সার নগরী এখন ঢাকা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, নতুন করে রিক্সার অনুমোদন দেয়ার পরিকল্পনা নেই। এর সঙ্গে নতুন আপদ যোগ হয়েছে ইজিবাইক অথবা ব্যাটারিচালিত রিক্সা। অনুমোদনহীন এই পরিবহনটি সরকারীভাবে আমদানি নিষিদ্ধ হলেও তা কার্যকর হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দখল করে চলাচল করছে অন্তত লক্ষাধিক ইজিবাইক। জনবল সঙ্কটের মধ্য দিয়েও অবৈধ রিক্সা পাকড়াওয়ে অভিযান থেমে নেই। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে রিক্সা ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
রাজধানীতে বর্তমানে জনসংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ রিক্সার ওপর নির্ভর করে চলছে। মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ মানুষ চলে নিজস্ব পরিবহনে। বাস ও মিনিবাসে ২৫ ভাগ। সিএনজি ও ট্যাক্সিক্যাবে ৫ ভাগ। নিম্ন, মধ্যবিত্তসহ সকল পর্যায়ের ৬০ ভাগ মানুষ নিয়মিত রিক্সায় যাতায়াত করে। এই প্রেক্ষাপটে রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্সার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৫৫৪টি। প্রশ্ন হলো অবৈধ রিক্সার সংখ্যা তাহলে কত। ডিসিসি বলছে রাজধানীতে অননুমোদিত রিক্সার সংখ্যা সাত লাখের বেশি।
বাংলাদেশ রিক্সা ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ নেতারা বলছেন, ১৯৮৬ সালের পর নতুন কোন রিক্সার লাইসেন্স দেয়নি ডিসিসি। ১০ বছর আগে রাজধানীতে ৪৩ হাজার রিক্সা ও ভ্যানের লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আজও তা ঝুলে আছে। সঙ্কট সমাধানে রিক্সার বিকল্প হিসেবে রাজধানীর সরু রাস্তায় ফোর হুইলার ও মিনিবাস চালুর কথা বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বিগত তিন বছর ধরে রিক্সার লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রেখেছে ডিসিসি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, ডিসিসির বৈধ রিক্সা ৭০ হাজারের কিছু বেশি হলেও এর পাঁচ গুণের বেশি ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত চলাচল করছে। রাজধানীতে যানজটের অনেক কারণের মধ্যে রিক্সা একটি এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে কথা হলো হঠাৎ করে রিক্সা ওঠানো যাবে না। এর আগে চালকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। রিক্সা বিকল্প হিসেবে সরু রাস্থায় ১২ সিটের ফোর হুইলার ও মিনিবাস দেয়া যেতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীতে থ্রি হুইলার চলাচলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বিভিন্ন রুটে এই পরিবহনের লাইসেন্স দেয়া শুরু করেছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। আশা করি রাজধানীর যানজট নিরসনে সবাই এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ রিক্সা ভ্যান মালিক-শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বলছেন, ১৯৮৬ সালের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে অযান্ত্রিক পরিবহনের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রয়েছে। ২০০১ সালের ৬ নবেম্বর রাজধানীতে ৩৫ হাজার রিক্সা ও আট হাজার ভ্যানের লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তা এখন পর্যন্ত কার্যকর হচ্ছে না। পরিষদের সদস্য সচিব মোঃ ইনসুর আলী বলেন, নতুন রিক্সার লাইসেন্স দেয়ার দাবি জানান।
নগরজুড়ে রিক্সার নৈরাজ্য চলছে। আপনি যেখানেই যেতে চান না কেন-রিক্সায় চলাচল করতে চাইলে হিসেব করে টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হলে চলবে না। কারণ দিনে তিন দফা রিক্সা ভাড়া ওঠানামা করে। সকালের অফিসের সময়, দুপুরের কড়া রোদ আর বিকেলের অফিস ছুটির সময় ভাড়া গুনতে হবে দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ মতিঝিল থেকে বাসাবো পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা হলে ব্যস্ত সময়ে গুনতে হবে থেকে ৪০-৫০ টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সুমন প-িত জানান, মতিঝিল থেকে আহাম্মবাগের রিক্সা ভাড়া দু’এক বছর আগেও ছিল সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ টাকা। সম্প্রতি তালতলা থেকে মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস সার্ভিস চালু হয়েছে একাধিক। হিউম্যান হলার, ইজিবাইক বেড়েছে। এর মধ্যেও রিক্সা ভাড়া বেড়ে হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা পর্যন্ত। বাংলামোটর থেকে মগবাজার পর্যন্ত রিক্সা ভাড়া আগে ৫ টাকা হলেও এখন নেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ টাকা। মালিবাগ রেলগেট থেকে নতুন বাজার যেতে হলে ৬০-৮০ টাকা ভাড়া হাঁকাচ্ছেন রিক্সাচালকরা। এ রকম ভাড়ার নৈরাজ্য সবখানেই। চালকরা বলছেন, আগের চেয়ে রিক্সার জমা বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। তাই বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে।
লাইসেন্স নেইÑ নেই ট্রাফিক আইনের ধারণা ॥ রাজধানীর রিক্সাচালকের মধ্যে ৫০ জনে একজন বৈধচালক পাওয়া দায়! অনেকের লাইসেন্স আছে তবে বৈধ নয়। মগবাজার আমতলা এলাকার রিক্সাচালক ফিরোজ মিয়া জানালেন, তাঁর হাতে একটি লাইসেন্স আছে। যা দুই হাজার টাকা দিয়ে দালালদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন তিনি। তা দিয়েই ছয় বছর রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছেন। বৈধ নম্বর দিয়ে অন্তত ২০টি রিক্সা চলছে এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন রাজধানীর মান্ডা এলাকার চালক সাকিব মিয়া। তিনি জানান, অবৈধ সব কাজ মালিকপক্ষ করেন। আমাদের কাজ গাড়ি চালানো আর টাকা দেয়া।
ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা আছে এমন চালক এক শ’তে একটিও মেলে না। তবুও তারা রাজধানীর চালক। তবে তাদের মধ্যে অনেকে আছেন অলিগলিতে রিক্সা চালান। ভয় একটাই তাহলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। লাইসেন্স নেই। নেই গাড়ি চালানোর বৈধ কোন কাগজপত্র। যে কোন সময় পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ার আশঙ্কায় অলিগলিতে সীমাবদ্ধ থাকে চলাচল।
রিক্সাসহ বিভিন্ন পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে গুনতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। এই প্রেক্ষাপটে এলাকাভিক্তিক ভাড়া নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেই এ উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে রিক্সা ভাড়া নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনসহ পৌরসভায় ভাড়া নির্ধারণের নজির রয়েছে।
ব্যাটারিচালিত রিক্সার কী হবে ॥ সরকারীভাবে ব্যাটারিচালিত রিক্সা আমদানি নিষিদ্ধ করা হলেও প্রতিমাসে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে লক্ষাধিক ইজিবাইক বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন গলি সড়কে চলছে এই পরিবহনটি। অথচ সিটি কর্পোরেশন, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে শুরু করে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটিসহ (আরটিসি) কোন প্রতিষ্ঠান থেকেই এই পরিবহন চলাচলে অনুমোদন দেয়া হয়নি। তবুও চলছে।
খিলগাঁও রেলগেটের মতো ব্যস্ততম সড়কের ওপরে দু’ থেকে তিন সারি করে শত শত বাইক রাখা হচ্ছে। আছে হিউম্যান হলারও। যাত্রীর জন্য পরিবহন রাখা হয় রাস্তার ওপরে। এ কারণে যেমন যানজট লেগে থাকে তেমনি যে কোন সময় রেলগেটে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব পরিবহনের চালকদের দাবিÑ পুলিশকে টাকা দিয়েই তাঁরা চলছেন। খিলগাঁও রেলগেট বলে কথা নয়, রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে ইজিবাইক চলছে অহরহ। বাস্তবতা হলো কেউ আইন মানছে না। তাই বলে কি আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে সবকিছু।

No comments

Powered by Blogger.