প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আশুলিয়া পরিস্থিতি শান্ত-শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে আহত দেড় শতাধিক

বেতন বাড়ানোর দাবিতে আশুলিয়ার পোশাক কারখানার শ্রমিকরা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন। সরকার ও মালিকপক্ষের কাজে ফেরার আহ্বান উপেক্ষা করে গতকাল বুধবার রাজধানীর অদূরের এ শিল্পাঞ্চলের প্রায় ৩০০ কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।


একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহার করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ, শ্রমিক ও পথচারীসহ দেড়শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসের কথা জানিয়ে মাইকিং করার পর দুপুরের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
ঢাকার সাভার উপজেলায় আশুলিয়ার বাংলাবাজার এলাকায় অবস্থিত হা-মীম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে গত রবিবার বিক্ষোভ শুরু করেন। ওই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায়। গত সোমবারও উত্তাল ছিল আশুলিয়া।
শিল্প পুলিশ-১ আশুলিয়া জোনের পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল সকালে বাংলাবাজারে হা-মীম গ্রুপের কারখানা আর্টিস্টিক ডিজাইন লিমিটেডের শ্রমিকরা কারখানায় এসে বন্ধের নোটিশ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন। শ্রমিকরা নরসিংহপুর, জামগড়াসহ সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে টায়ার ও কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন নরসিংহপুর, জিরাব, আশুলিয়া, ঘোষবাগ, বেরন, জামগড়া, গুমাইল, বাংলাবাজার, ধনাইদ, শিমুলতলা, ইউনিক, বগাবাড়ী, বাইপাইল, বুড়ির বাজার, শ্রীপুর, জিরানী, পলাশবাড়ী, পুকুরপাড় ও ডেণ্ডাবরসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ৩০০টি কারখানার শ্রমিক।
বিক্ষোভের একপর্যায়ে শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করেন। সকাল সোয়া ৯টার দিকে জামগড়া এলাকায় পুলিশ শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। শ্রমিকদের ছোড়া ইটের আঘাতে পুলিশের অন্তত ১৫ জন সদস্য আহত হন।
একপর্যায়ে শ্রমিকরা বাইপাইল অতিক্রম করে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) দিকে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। বাইপাইল-নরসিংহপুর ও পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে র‌্যাব সদস্যরাও মাঠে নামেন। পুলিশ ও র‌্যাবের তৎপরতায় শ্রমিকরা সড়ক থেকে সরে গেলে দুপুর ১২টার দিকে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা অবস্থায় শ্রমিকরা ২৫-৩০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষে দেড় শতাধিক শ্রমিক ও অন্তত ১৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।
হা-মীম গ্রুপের আশুলিয়া জোনের নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আলী মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, আশুলিয়ার নরসিংহপুরে ওই গ্রুপের এঙ্প্রেস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড নামের কারখানায় মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে রাতের পালার শ্রমিকরা কাজ করতে আসেন। ওয়েট প্রসেসিং বিভাগের শ্রমিকরা কাজ শুরু করেন। কিন্তু ড্রাই প্রসেসিং বিভাগের শ্রমিকরা কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। তাঁরা ওয়েট প্রসেসিং বিভাগে গিয়েও শ্রমিকদের কাজ না করার জন্য বলেন।
হা-মীম গ্রুপের ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, কাজ করা-না করা নিয়ে দুই বিভাগের শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তখন শিল্প পুলিশের একটি দল শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। পুলিশও পাল্টা লাঠিপেটা শুরু করে।
শ্রমিকরা জানান, কারখানা কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডেকে এনে তাঁদের মারধর করে। পুলিশের লাঠিপেটায় নারী শ্রমিকসহ অন্তত ৫০ জন শ্রমিক আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ২০ জনকে রাতে স্থানীয় নারী ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা জানিয়ে মাইকিং
শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করে সমাধান করবেন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন আশ্বাস দিয়েছেন বলে মাইকিং করে জানানোর পর দুপুর ১২টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। শ্রমিকদের ধৈর্য ধরারও আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে অবহিত আছেন। বুধবার সকালে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শ্রমিকদের ধৈর্য ধরতে অনুরোধ জানানো হয়। তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বসবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
আশুলিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দুপুরের আগেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে রাস্তায় পুলিশের টহল জোরদার করা হয়।'
এএসপি জানান, শিল্পাঞ্চলে টানা তিন দিনের বিক্ষোভ, ভাঙচুরের ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি এবং কাউকে আটকও করা হয়নি।
ইন্ধনদাতাদের খুঁজতে কমিটি, আজ থেকে কারখানাগুলো চালু
এ দিকে গত তিন দিন ধরে শুরু হওয়া অস্থিরতা ও বন্ধ থাকা আশুলিয়া এলাকার সব পোশাক কারখানা আজ বুধবার থেকে চালু থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই সব পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে হবে। গতকাল সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে পোশাক কারখানার মালিক-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টদের একটি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আশুলিয়ায় পোশাক শিল্পে অসন্তোষকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় শ্রমিকরা জড়িত নয়। তাই কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করতে বৈঠকে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদকে। মন্ত্রী বলেন, 'কারা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত, তা জানা দরকার। এ জন্য বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।'

No comments

Powered by Blogger.