ট্রাফিক-ব্যবস্থা-‘এখানে কোন বাস থামিবে না’ by এ কে এম জাকারিয়া

‘এখানে কোন বাস স্টপেজ নাই, এখানে কোন বাস থামিবে না। আদেশক্রমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, পশ্চিম, ডিএমপি ঢাকা।’ কারওয়ান বাজারে সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেটের দিকে যেতে এই বাক্য দুটি লেখা একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়বে।


আরও চোখে পড়বে, সেখানে অনেক লোক বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, বাস থামছে এবং যাত্রীরা উঠছেন, নামছেন। সেখানে ট্রাফিক পুলিশও চোখে পড়বে। প্রশ্ন জাগতে পারে, সাইনবোর্ডটি তবে কেন আছে? কারণ, এটা যে বাসস্টপেজ নয় এবং এখানে যে যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না তা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। কেউ তা মানুক বা না মানুক, তাতে কী আসে যায়!
ট্রাফিক-ব্যবস্থার কিছু সাধারণ নিয়ম আছে। বিশ্বের যে দেশেই আপনি যান, কিছু চিহ্ন দেখে আপনি বুঝতে পারবেন ট্রাফিক-ব্যবস্থার নানা দিক। কোথায় বাস থামবে, কোথায় থামবে না, কোথায় গাড়ি পার্ক করা যাবে বা কোথায় যাবে না। ডানে-বাঁয়ে কোন দিকে মোড নেওয়া যাবে বা যাবে না। যাঁরা ড্রাইভিং স্কুলে গিয়ে ড্রাইভিং শিখেছেন, তাঁদের এই চিহ্নগুলোর অর্থ শেখানো হয়। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য গাড়ি কতটা চালাতে পারেন সে পরীক্ষায় যেমন পাস করতে হয়, তেমনি কোন চিহ্নের কী অর্থ সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েও পাস করতে হয়। তবে এই চিহ্নগুলো এমন, সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি আছে এমন যে কেউ তা বুঝতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু এসব চিহ্নে কাজ হয় না। সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বড় বড় করে লিখতে হয়—‘এখানে কোন বাস স্টপেজ নাই, এখানে কোন বাস থামিবে না।’ কিন্তু এরপর বাস থামবে, কখনো বাসের গতি ধীর হবে এবং এর মধ্যে যাত্রীরা ওঠা-নামা করবেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং তা ট্রাফিক পুলিশের সামনেই।
যাত্রীদের দোষ কী! বাসের জন্য নির্ধারিত স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকলে সেই যাত্রীর ভাগ্যে হয়তো কখনো বাসে ওঠাই হবে না। বাস-মিনিবাসগুলো চলতে চলতে রাস্তা থেকে যাত্রী তুলতেই যেন বেশি আগ্রহী। তারা এ কাজটি করতে পারে, কারণ বাসগুলোয় ওঠার পথে দরজা লাগানোর ব্যবস্থা নেই। বাসে ওঠার পথে দাঁড়িয়ে থাকেন একজন ‘হেলপার’, যিনি চলন্ত অবস্থায় যাত্রীদের উঠতে ও নামতে যেমন ‘হেল্প’ করেন, তেমনি ক্রমাগত গাড়ির শরীর বা বডিতে থাপড় মেরে ‘বাঁয়ে প্লাস্টিক’ বা এ ধরনের কিছু সাংকেতিক শব্দে সহায়তা করেন বাসের চালককে। এই হেলপারকে ছাড়া বাস বা মিনিবাসের চালক প্রায় অন্ধ। একটু খেয়াল করলে দেখবেন ঢাকায় চলাচল করে এমন বাস-মিনিবাসগুলোর অধিকাংশের বাঁ দিকের লুকিং মিরর বলে কিছু নেই। ডান দিকে চালক খেয়াল করতে পারেন, কিন্তু বাঁ দিকের জন্য এই হেলপারের সহায়তা ছাড়া কোনো পথ নেই। বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম! সাধারণভাবে সুশৃঙ্খল ট্রাফিক-ব্যবস্থা আছে এমন কোনো দেশে এ ধরনের হেলপারের কোনো ব্যাপার নেই। বাসের চালকই যথেষ্ট। বাস যখন চলে তখন তার দরজা বন্ধ থাকে। বাসস্টপেজে গিয়ে থামলে ড্রাইভার দরজা খোলার বোতাম চাপেন, দরজা খুললে যাত্রীরা নামেন, যাঁরা ওঠার তাঁরা ওঠেন। দরজা বন্ধ করার পরই আবার চলতে শুরু করে বাস।
বাংলাদেশে হয়তো এখনই বোতাম টিপে বাসের দরজা খোলার ব্যবস্থা করা যাবে না বা হেলপার ছাড়াও বাস চালানো যাবে না; কিন্তু বাস চলার সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখার বিধান তো কার্যকর করা যায়। বাসস্টপেজ ছাড়া বাসের দরজা খোলা যাবে না—এই বিধান কার্যকর করা গেলে অন্তত যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ করা যাবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের কোনো আইন করলে যে তা কার্যকর করা যাবে, তার নিশ্চয়তা কী! যানজট কমাতে হঠাৎ করেই লেন মেনে গাড়ি চালানোর বিধান কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হলো গত ডিসেম্বরে। কবে থেকে লেন মেনে গাড়ি চালাতে হবে তাও ঠিক করে দিল। গাড়ি লেন মেনে চলবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলাদেশে লেন মেনে গাড়ি কবে থেকে চলবে তা ঘোষণা দিয়ে জানাতে হয়। কার্যকর হওয়ার দিন থেকে শুরু হলো বিভ্রান্তি, অনেক রাস্তায় লেনের দাগই নেই। কয়েক দিন এ নিয়ে বিশৃঙ্খলা চলল, ট্রাফিক পুলিশ একপর্যায়ে তা কার্যকর করা থেকে সরে এল। এ বছর আগস্টে আবার দ্বিতীয় দফা কার্যকর করার ঘোষণা এল। এবার পত্রিকার শিরোনাম ‘আবার লেন মানায় কড়াকড়ি’। দ্বিতীয় দফার উদ্যোগও ব্যর্থ। লেন মেনে চলার বিধান এখন আর কার্যকর নয়। আগের মতোই এলোমেলো। এ বছর জুলাই মাসে ঘোষণা এল রাজধানী ঢাকায় ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাস এবং ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলবে না। ঘোষণা দেওয়া হলো ১৫ জুলাই থেকে অভিযান চলবে। শুরুও হয়েছিল, কিন্তু যথারীতি ব্যর্থ। এবার আবার এক নতুন ঘোষণা এসেছে, গাড়ির চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বেঁধে চলতে হবে, মোটরসাইকেলের চালকদের পরতে হবে হেলমেট আর যানবাহন চলানোর সময় কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারবে না। এসব মানতে বাধ্য করতে কবে থেকে অভিযান চলবে তাও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, তারিখটি আগামী ১ নভেম্বর। দেখা যাক কী হয়!
ঈদের পর ঢাকা আবার আগের রূপ নিয়েছে। যানজটের সমস্যা মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের বাস্তবতা বিবেচনায় নিলেও দুটি সাধারণ দিক মেনেই পরিকল্পনা করে থাকে। ১. ট্রাফিক-ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। ২. অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা। আমাদের দেশে ট্রাফিক-ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের চেষ্টায় কিছুদিন পরপর কিছু নির্দেশনা ও তার ফলাফল আমরা দেখলাম। এখন অবকাঠামোগত নানা পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে, এগুলো একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি এর সঙ্গে প্রচুর অর্থের ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক-ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও আইনের বিধিবিধানগুলো কার্যকর করলে পরিস্থিতি অন্তত কিছুটা সহনীয় হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়া ও ফিটনেসবিহীন ৮০ হাজার ৬১৫টি গাড়ির তালিকা তৈরি করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, এই গাড়িগুলো অবৈধভাবে চলাচল করছে। যানজটের সমস্যা দূর করতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের নিশ্চয়ই প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ কই? যেমন, ফিটনেসবিহীন এই গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়া গেলে অন্তত রাস্তাগুলো কিছুটা ফাঁকা হবে। যানজট কিছুটা হলেও কমবে। যানবাহন চলাচল ও নিয়ন্ত্রণের এই ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন বা পরিকল্পনা ও তা কার্যকর করার গুরুত্বটি নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে মনে হয় না।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের নানা পরিকল্পনার কথা অবশ্য জোরের সঙ্গেই শোনা যাচ্ছে। একটি বড় প্রকল্পের দরপত্র ডাকার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হতে যাচ্ছে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক। এত টাকা খরচ করে এই যে উড়াল সড়ক হতে যাচ্ছে, তাতে যানজট কতটুকু কমবে? গত কয়েক দিনে কয়েকজন পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদের সঙ্গে আলাপ করে যে ধারণা হলো তা মিশ্র। বুয়েটের শিক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. সারোয়ার জাহান এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে বলেছেন, এই উড়াল সড়ক বাস বা গণপরিবহনের জন্য উপযুক্ত নয়। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী ছাড়া আর কারও জন্য এই উড়াল সড়ক কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এত জনঘন এই শহরে যেখানে গণপরিবহনের সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি, সেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীদের সুবিধার জন্য এত অর্থের খরচ কতটুকু যৌক্তিক সে প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। ঢাকা শহরের শতকরা কত ভাগ লোক ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেন তার একটি হিসাব রয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) একটি সমীক্ষায়। রিকশা, বাস ও হাঁটা—গন্তব্যে যাওয়ার জন্য এই মাধ্যমগুলোর বাইরে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল বা সাইকেলে চড়ে চলাচল করেন মাত্র দুই থেকে সাত শতাংশ যাত্রী। এই সামান্যসংখ্যক যাত্রীর জন্য ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করে উড়াল সড়ক নির্মাণে সরকার কেন উদ্যোগী হলো সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সারোয়ার জাহানের মতে, টোল আদায়ের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করা অর্থ তোলার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে সফল হবে না। সরকারের হয়তো ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এই প্রকল্পের কঠোর বিরোধিতা করেছেন। সারোয়ার জাহান অভিযোগ করেছেন, ‘একটি বিশেষ গোষ্ঠী ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সরকারকে বিশাল অঙ্কের জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহিত করেছে।’
এই উড়াল সড়ক নির্মাণে রেলের জায়গা ব্যবহার হওয়ায় ভবিষ্যতে রেল সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। ঢাকার মতো জনবহুল একটি শহরের জন্য সবচেয়ে কার্যকর গণপরিবহন মেট্রো রেল যদি ভবিষ্যতে করতে হয় সে ক্ষেত্রেও এই উড়াল সড়ক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। উড়াল সেতুর অবকাঠামোর নিচে অনেক জায়গা নষ্ট হবে এবং তা কাজে লাগানো যাবে না। সব মিলিয়ে তাঁরা বলছেন এই উড়াল সড়ক যানজট না কমিয়ে বরং বাড়াবে। তাঁদের মতে, ২১ কিলোমিটারের উড়াল সড়ক নির্মাণের অর্থ দিয়ে পুরো ঢাকায় (প্রায় ৪০০ কিলোমিটার) গণপরিবহনের আধুনিক ব্যবস্থা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সম্ভব। এই আধুনিক ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট লেন দিয়ে বাস চলবে, চাইলেই ডানে-বাঁয়ে যেতে পারবে না, নির্দিষ্ট স্টেশন ছাড়া বাস থামতেও পারবে না। এর সঙ্গে অন্যান্য গণপরিবহনের সমন্বয় করে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। এসব যুক্তির বিবেচনায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ১৮ হাজার কোটি টাকার উড়াল সেতু অর্থনাশের পাশাপাশি ঢাকায় ভবিষ্যতে একটি কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলাকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
পরিবহনবিশেষজ্ঞ ড. রহমতউল্লাহ অবশ্য এই যুক্তি মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন উড়াল সড়ক গণপরিবহনের ক্ষেত্রে হয়তো কাজে লাগবে না কিন্তু রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ অনেক কমাবে। জ্যাম এড়াতে অধিকাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি টোল দিয়ে উড়াল সড়কে যাতায়াত করবে। তাঁর হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন ৪০ থেকে ৬০ হাজার যান উড়াল সড়কে চলাচল করবে, যা নিচের রাস্তায় যানবাহনের চাপ কমাবে। তবে তিনি মনে করেন শুধু উড়াল সড়কে কাজ হবে না, একই সঙ্গে মেট্রো রেল ও বিআরটির সমন্বয়ে একটি কার্যকর গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উড়াল সড়কের কারণে মেট্রো রেল বা বিআরটি নেটওয়ার্ক যাতে কার্যকর করা দুরূহ হয়ে না পড়ে সে জন্য তিনি উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ শুরুর আগেই অন্য নেটওয়ার্কগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে সমন্বয় করার ওপর জোর দিয়েছেন।
উড়াল সড়কের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ যেসব আপত্তির দিক তুলে ধরেছেন ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ার যে আশঙ্কা করেছেন তা বিবেচনায় নিয়ে পুরো বিষয়টি আবার পর্যালোচনা করা উচিত। আর সবগুলো নেটওয়ার্কের মধ্যে সমন্বয় করে যদি শেষ পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণ করতে হয়, সে ক্ষেত্রেও হাতে খুব বেশি সময় নেই। কারণ, উড়াল সড়কের কাজ শুরুর টেন্ডার ডাকার প্রস্তুতি চলছে। আগামী বছরের প্রথম দিকে কাজ শুরু হওয়ার কথা।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.