তরুণদের সামাজিক ফিকশন তৈরি করতে বললেন ড. ইউনূস

সামাজিক ফিকশন (কল্পকাহিনী) তৈরি করতে তরুণদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, মানুষ কোনো কিছু কল্পনা করলে বিজ্ঞান তা বাস্তবায়নের পেছনে ছোটে। একসময় মানুষ চাঁদে যাওয়ার কল্পনা করেছিল।


এখন মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহে যায়। কিন্তু দুঃখ হলো, এখন পর্যন্ত কোনো সামাজিক কল্পনা তৈরি হয়নি। তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমরা সামাজিক ফিকশন তৈরি করো, যাতে তোমরাই সেটা বাস্তবায়ন করতে পারো।
গতকাল মঙ্গলবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ব্যবসার ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. ইউনূস এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্টারপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি) ও এন্টারপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (ইডিএফ) যৌথভাবে ড. ইউনূসের এ বক্তৃতার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান।
সামাজিক ব্যবসার ধারণা ব্যাখ্যা করে ড. ইউনূস বলেন, সাধারণ ব্যবসার লক্ষ্য থাকে মুনাফা অর্জন। তবে সামাজিক ব্যবসার লক্ষ্য মানুষের সমস্যা সমাধান। মুনাফা সামাজিক ব্যবসায়ও করা হবে। তবে তা কারো ব্যক্তিগত হবে না। বিনিয়োগকারী শুধু তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থই ফিরিয়ে নিতে পারবেন।
ড. ইউনূস বলেন, 'সাধারণ ব্যবসার কাঠামোই হলো ব্যবসা করো আর মুনাফা অর্জন করো। কিন্তু একজন মানুষের সারাজীবনের লক্ষ্য কেবল মুনাফা অর্জন হতে পারে। মানুষ ডাকাত নয় যে, অর্থই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকবে। ব্যবসার ধরন সম্পর্কে আমরা শিক্ষা পেয়েছি- এটি কেবল মুনাফা অর্জনের মাধ্যম। কিন্তু একটু অন্যভাবেও ভাবা যায়। চোখের ওপর থাকা মুনাফার চশমা খুলে ফেললে নতুন কিছু চিন্তা করা সম্ভব।'
চ্যারিটিকে (দান-খয়রাত) 'অসাধারণ' উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, কিন্তু এটা টেকসই হয় না। দান-খয়রাতে বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত আসে না। কিন্তু সামাজিক ব্যবসা একটি টেকসই ধারণা। এর মাধ্যমে মানুষের সমস্যার সমাধানও হবে, আবার বিনিয়োগকারীর অর্থও ফেরত আসবে। আর চ্যারিটির জন্য পাওয়া গেলে সামাজিক ব্যবসার জন্য মানুষ টাকা দেবে।
সামাজিক ব্যবসা ও অন্য ব্যবসা পাশাপাশি চলতে পারে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ওই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'সামাজিক ব্যবসা অন্যান্য সাধারণ ব্যবসার ধারণাকে নাকচ করে দেয় না। আমি বলছি না, আপনি অন্য ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে সামাজিক ব্যবসা করুন। দুই ধরনের ব্যবসা একই সঙ্গে চলতে পারে।'
বিশেষ কিছু লোক উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় বলে মনে করেন না ড. ইউনূস। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক মানব সন্তানের মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার গুণাবলি আছে। কেউ সুযোগ পায়, কেউ পায় না। মানুষ তার সৃজনশীল ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করতে পারলে মানুষের সমস্যা সমাধান করতেও সে সৃজনশীল ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারবে।
ড. ইউনূস বলেন, 'জানি না আমরা কেন অর্থ অর্জন করি। প্রত্যেকের জীবনের একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। অনেক টাকা অর্জন করলেও মরে যাওয়ার পর মানুষ অনেককে মনে রাখে না। কিন্তু দশের একটি সমস্যা সমাধান করে গেলে মানুষ তাকে মনে রাখে।'
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, দারিদ্র্য দরিদ্র মানুষের সৃষ্টি নয়। এটার সৃষ্টি হয় ব্যবস্থার ভেতরে। এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারলেই দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। এটা খুবই হাস্যকর যে, সাধারণ ব্যাংক শুধু টাকাওয়ালাদেরই ঋণ দেয়। অথচ ঋণ দরকার তাদের, যাদের টাকা নেই। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ লোকের ব্যাংকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এটার পরিবর্তন দরকার বলেই আমরা গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি করেছি। এটিই পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যা দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম করে।'
ড. ইউনূস বলেন, 'আমাদের এসব ব্যবস্থাকে পাল্টাতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে একটা বাহন হতে পারে সামাজিক ব্যবসা। অনেক দেশে সামাজিক ব্যবসার তহবিল গড়ে উঠছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি পড়ানো হচ্ছে। সামাজিক ব্যবসার মূল বিষয় হলো- ব্যবসার ধারণা (আইডিয়া) তৈরি। অর্থায়ন এখানে কোনো সমস্যা না। তিনি শিক্ষার্থীদের সামাজিক ব্যবসার ধারণা তৈরির তাগিদ দেন। আর সহায়তার জন্য ইউনূস সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

No comments

Powered by Blogger.