নিভে গেল ধ্রুপদ সংগীত ও গজলের ধ্রুবতারা

কণ্ঠে ছিল তাঁর স্বর্গীয় সুষমা। দেশ-কালের সীমানা ছড়িয়ে সুরমাধুর্যে বিমোহিত করে রেখেছিলেন অগণিত মানুষকে। কিন্তু জরা আর ব্যাধির প্রকোপে দীর্ঘদিন তাঁর সেই কণ্ঠ ছিল সুরহারা। এবার তা নিঃশব্দ হলো চিরতরে। নিভে গেল ধ্রুপদ সংগীত ও গজলের ধ্রুবতারা।


চলে গেলেন উপমহাদেশের ধ্রুপদ সংগীতের প্রাণপুরুষ ও গজলসম্রাট মেহদি হাসান। করাচির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২২ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)।
মেহদি হাসানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। খবর জি নিউজ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এএফপি ও রয়টার্স।
ওস্তাদ মেহদি হাসান খান সাহেব নামে খ্যাতি পাওয়া মেহদি হাসান ১৯২৭ সালের ১৮ জুলাই ভারতের রাজস্থানের ঝুনঝুনু জেলার লুনা গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ধ্রুপদ সংগীত ও গজলে তাঁর দখল ছিল অতুলনীয়। লাহোরভিত্তিক চলচ্চিত্রশিল্প ললিউডে প্লেব্যাক করেছেন দাপটের সঙ্গে। আরেক বহুমাত্রিক প্রতিভাধর শিল্পী আহমেদ রুশদিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন পাকিস্তানি চলচ্চিত্রজগৎ শাসন করেছেন। ১৯৬২ সাল ছিল তাঁর জীবনে অনন্য এক বছর। ওই বছর তাঁর তিনটি গান হিট হয়। ১৯৬৪ সালে ফারাঙ্গি ছবিতে গাওয়া ‘গুল মে রাংগ ভারে’ গানটি তাঁকে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক ছিল তাঁর গায়কি জীবনের সবচেয়ে বর্ণিল অধ্যায়।
১৯৫৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন স্বীয় কর্মজগতে। এ সময় একে একে সৃষ্টি করেছেন বিস্ময়মাখা সব গান। ‘রাফতা রাফতা হো মেরে’, ‘দুনিয়া কিসকা পেয়ার’, ‘জিন্দেগি মে সাবহি পেয়ার কিয়া কারতি হে’, ‘বাত কারনি মুঝে মুশকিল’, ‘রানজিশ হি সাহি’, ‘ঢাকো যত না নয়ন দুহাতে’, ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’—এ রকম বহু গান তৈরি করে সারা বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের মনে আবির মাখিয়ে দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে তিনি উর্দু, বাংলা, পাঞ্জাবি ও আফগান ভাষায় ২০ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন।
মেহদি হাসানের গানের হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর বাবা ওস্তাদ আজিম খান ও চাচা ওস্তাদ ইসমাইল খানের কাছে। দুজনই ছিলেন ধ্রুপদি গায়ক। পেশাদার গায়ক হলেও তিনি ছিলেন এক অনন্য সংগীত পরিচালক। অসাধারণ বাদনশৈলীতে হারমোনিয়াম বাজানোর বিষয়টি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’, ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ ও ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’, ‘শাহেনশাহ-ই-গজল’ উপাধিতে ভূষিত করে। এ ছাড়া ১৯৭৯ সালে ভারত সরকার ‘সায়গল অ্যাওয়ার্ড ইন জলন্ধর’ এবং ১৯৮৩ সালে নেপাল সরকার তাঁকে ‘গোর্খা দক্ষিণা বাহু’ উপাধি দেয়।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও দুঃখ-কষ্ট সয়ে বড় হয়েছেন এই গজলসম্রাট। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পরিবারসহ পাকিস্তানের সহিওয়াল জেলার ছিচা ওয়াতনি এলাকায় থিতু হন তাঁরা। এর পর থেকে প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়েন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০ বছর। আর্থিক কষ্ট লাঘবের জন্য তিনি একটি বাইসাইকেলের দোকানে কাজ নেন। শত দারিদ্র্য ও কষ্ট সত্ত্বেও গান থেকে দূরে সরে যাননি। গানের চর্চা করে গেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১৯৫৭ সালে ঠুমরি গায়ক হিসেবে পাকিস্তান বেতারে গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পর থেকে আর্থিক সংকট কাটতে থাকে মেহদি হাসানের। এটাই তাঁকে ধীরে ধীরে সংগীতজগতে পরিচিত করে তোলে। তখন তিনি উর্দু কবিতার প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং পরীক্ষামূলকভাবে গজল গাওয়া শুরু করেন। সে সময় পাকিস্তানের সংগীতাকাশে আলো ছড়াচ্ছিলেন ওস্তাদ বরকত আলী খান, বেগম আখতার ও মুখতার বেগম।
গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন মেহদি হাসান। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় চলচ্চিত্রে গান গাওয়া। এর পর থেকে অসুস্থতা বেড়ে গেলে ধীরে ধীরে সংগীত থেকে দূরে সরে যান তিনি। জীবনের শেষ দিনগুলো করাচিতে তাঁর নিজ বাড়িতে কেটেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাঝে মাঝে লাহোরে বেড়াতে যেতেন, যেখানে কেটেছে তাঁর সংগীতজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো। ব্যক্তিগত জীবনে নয় ছেলে ও পাঁচ মেয়ের বাবা ছিলেন মেহদি হাসান। সন্তানদের অধিকাংশই তাঁর মতো গানের প্রতি আগ্রহী।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি মেহদি হাসানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন এক আইকন। সুরের সম্মোহনী শক্তি দিয়ে তিনি পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমীদের দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন রেখেছেন।’ তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ভারতের জীবন্ত কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মেহদি হাসানের মৃত্যুতে অনেক বড় ক্ষতি হলো।’

No comments

Powered by Blogger.