বৃদ্ধাশ্রম-বয়স্ক মানুষেরা ভালো নেই by তৌফিক মারুফ

* সন্তানের কাছে থাকার আকুতি কোনোই গুরুত্ব পাচ্ছে না * মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পারিবারিক নিপীড়ন বাড়ছে
* পুনর্বাসনে সরকারি ব্যবস্থাপনা নেইঘন গভীর গজারি বনের মাঝখানে সাজানো-গোছানো বাগানঘেরা দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। থেকে থেকে চেনা-অচেনা পাখির কলরব। ফুলে-ফলে ভরে আছে চারদিক।
কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ মৌসুমি সব ফলের সমারোহ গাছে গাছে। বিশাল বাগানের এখানে সেখানে গাছের ছায়ায়, খোলা আকাশের নিচে বেঞ্চ পাতা। কোথাও আবার টালির ছাউনিতে ঢাকা বসার স্থান। গোয়ালে গরু। দীঘি ভরা মাছ। ইট বিছানো পথ এদিক সেদিক ঘুরে-ফিরে আবার মিশে গেছে এক পথে। এসবের ফাঁকে বহুতল ভবনের বারান্দায় একদল মানুষ। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ বা আবার পায়চারিরত। কক্ষের ভেতরে কয়েকজন শুয়ে আছেন জড়োসড়ো হয়ে। সবাই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কেউ বেশি কেউ একটু কম।
বারান্দার কাছেই ডালিম গাছের ফাঁক গলে উঁকি দেওয়া সূর্যের দিকে চোখ তুলে একজন বিড়বিড় করে কী সব বলেই চলেছেন! দুই চোখের পানি বেয়ে নামছে ভাঁজ পড়া গালের ওপর দিয়ে। এক হাত দিয়ে চেপে ধরে আছেন নাক! এটা কী করছেন- জানতে চাইলে মাথা না নামিয়েই বললেন, 'স্বর্গে খাড়াইয়া নরক দেহি, নরকের ওই সাপ-বিচ্ছুগুলান আমারে কম জ্বালায় নাই। এহনও সুযোগ পাইলেই আমার নাক দিয়া শ্বাসের মধ্যে ঢুইক্যা পড়তে চায়। হেই জন্য সাপগুলারে সূর্যের কাছে বাইন্দা রাখতে কই।' পরে নিজেই জানালেন, নাম মজিবুর রহমান চুন্নু, বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম উত্তরপাড়া এলাকার খোন্দকার বাড়ি।
পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বলেন, 'ওনার মাথা ঠিক নাই, গণ্ডগোলে ধরছে।' অল্প দূরেই দাঁড়ানো আরেক বয়োবৃদ্ধ। তাঁরও দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ধরা গলায় বলেন, 'বাবা রে, উনি পাগল না। ওনার কেউ নাই, জীবন বাঁচাইতে এইখানে আইছেন। কিন্তু ওনার মনের মইধ্যে যে যন্ত্রণা আছে, সেইটা সাপ হইয়া দেখা দিলে উনি এমন করেন। আমগো সবার মনেই ওই রকম যন্ত্রণা আছে। কারো কম, কারো বেশি।'
বারান্দায় বসে আনমনে একদিকে তাকিয়ে থাকা আবদুল জলিল বলেন, 'আগে ঢাকার ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতাম। বাড়ি বিক্রমপুরের শ্রীনগরে। তিন ছেলে আছে যার যার সংসার নিয়ে। আমি এখানে আছি তিন বছর। কেউ একবারের জন্য দেখতেও আসেনি।' দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জলিল বলেন, 'আমাগোর অনেকেরই সন্তান থাকতেও তাগো কাছে থাকতে পারি না। আমরা তো খালি একটু সন্তানের কাছে থাকতে চাই।' কুমিল্লার দাউদকান্দির আবুল বাসারের বয়স প্রায় ৮০ বছর। স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে যেন থেকেও নেই। বাড়িঘর আর স্বজন ছেড়ে এখানে আছেন এক বছর ধরে।
এটা বৃদ্ধাশ্রম। কাগজ-কলমে শোভনীয় নাম 'বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র'। গাজীপুরের হোতাপাড়া মনিপুর এলাকার বিশিয়া-কুড়িবাড়িতে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা ২০৮ জন। তাঁদের মধ্যে বৃদ্ধা ১১১ জন। বৃদ্ধের সংখ্যা ৯৬ জন। জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসা এই মানুষগুলো পরিবারবঞ্চিত। একপ্রকার নিরুপায় হয়েই তাঁরা আজ এখানে। তবু বলা যায়, তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদেরই মতো দেশের আরো বিপুলসংখ্যক বয়স্ক নারী-পুরুষের খবর কে রাখে? তাঁরা রয়ে গেছেন সামান্য এতটুকু সুবিধার বাইরে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে এটাই দেশের সবচেয়ে বড় বৃদ্ধাশ্রম। একই কেন্দ্রের আরেকটি শাখা রয়েছে রাঙামাটিতে। এ ছাড়া সাভারে জিরানী বাজারের কাছে বিএনপি নেতা আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালু প্রতিষ্ঠিত আরেকটি বেসরকারি বয়স্ক আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের একটি প্রবীণ নিবাস থাকলেও সেখানে মাসিক খরচ দিয়ে থাকতে হয় বলে হতদরিদ্রদের থাকার সুযোগ নেই।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অসহায় প্রবীণদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে 'শান্তিনিবাস' চালু হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ২০০৩ সালে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিবর্তে এসব শান্তিনিবাসে শিশু ও কিশোরীদের জন্য 'সেইফ হোম' প্রকল্প চালু করা হয়। বয়স্কদের জন্য বর্তমানে সরকারিভাবে সচল কোনো কার্যক্রম নেই।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বয়স্ক জনগোষ্ঠী ক্রমেই দুঃসময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক সংকটের ফলে প্রথাগত যৌথ পরিবার অস্তিত্ব হারাচ্ছে। বদলে একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এতে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা পারিবারিক মমত্ব ও যত্নআত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বঞ্চিত এসব বয়োজ্যেষ্ঠকে পুনরায় পারিবারিক পরিমণ্ডলে দিন অতিবাহিত করার অধিকার ফিরিয়ে দিতে জনসচেতনতার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
এমনই বাস্তবতায় এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২৮ মার্চ বয়স্ক মা-বাবার ভরণ-পোষণে সন্তান যেন বাধ্য থাকে তা নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়নে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের সভাপতি খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল রিটটি দায়ের করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুন নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবাদে দেশে মৃত্যু হার কমছে। স্বভাবতই বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু। বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও। এখন দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এই হারের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের পর এ সংখ্যা দেশের মোট তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেকটাই ছাড়িয়ে যাবে। তাই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জরুরিভিত্তিতে প্রবীণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করা দরকার।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) জুলফিকার হায়দার জানান, সব জেলায় সরকারি শিশু পরিবারের কাছাকাছি স্থানে বয়স্কদের জন্য পুনরায় শান্তিনিবাস স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কার্যকরের প্রক্রিয়া চলছে। জনবল কাঠামো ও বাজেট না পাওয়ায় তা বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় প্রবীণদের জন্য 'জীবন পরিচর্যা' শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব সমাজসেবা অধিদপ্তরে বিবেচনাধীন।
গাজীপুরে দেশের সর্ববৃহৎ বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও গিভেন্সি গ্রুপের চেয়ারম্যান খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নিপীড়িত অসহায় বয়স্ক মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করার উদ্দেশ্য নিয়েই এ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার এখানে আশ্রয় নেওয়া ২০০ জনের বেশি প্রবীণকে কবর দিয়েছি। কয়েকজনের মৃত্যুর খবর তাঁর সন্তানদের জানালেও তারা মা-বাবার মৃত মুখটা পর্যন্ত দেখতে আসেনি। আবার কেউ কেউ দুই-তিন বছরেও একবার খোঁজ নিতে আসেনি। অনেক মা-বাবা মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো একবার সন্তানের মুখ দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু খবর দেওয়া সত্ত্বেও সেই সন্তানরা আসেনি।'
বিশিয়া-কুড়িবাড়িতে বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক আবু শরীফ জানান, ৭২ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রে ষাটোর্ধ্ব সব ধর্মের অসহায় নারী-পুরুষ থাকতে পারেন বিনা খরচে। বেডের ব্যবস্থা আছে ২৫০টি। সার্বক্ষণিক থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, বিনোদন ও ধর্ম-কর্মের সুযোগ রয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেবা ও পরিচর্যার মাধ্যমে প্রবীণদের জীবন সহজ ও আনন্দপূর্ণ করতে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা কর্মসূচি চালু রয়েছে। মাসিক ভাতার পরিমাণ ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় বাড়ানো হয়েছে। ভাতাভোগীর সংখ্যা ২২ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৪ লাখ ৭৫ হাজার করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে বিধবা ভাতাও। পাশাপাশি সরকার প্রবীণ হিতৈষী সংঘের কার্যক্রমে সহায়তা দিয়ে থাকে।
প্রবীণ হিতৈষী সংঘ সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে তারা বার্ষিক বরাদ্দ পায় ৫৫ লাখ টাকা। জেরিয়াট্রিক ইনস্টিটিউট স্থাপন, উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ, প্রবীণ ক্লাব ও ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠাসহ আরো নানা পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
'সবাইকে ছেড়ে থাকাই কপালে আছিল'

No comments

Powered by Blogger.