সরল গরল-অধ্যাপক সায়ীদের স্বস্তি, স্পিকারের অস্বস্তি by মিজানুর রহমান খান

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে কেন্দ্র করে স্পিকার মো. আবদুল হামিদের রুলিংয়ের চেতনাকে আমরা সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানাই। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী অনুশোচনার যে সলতে জ্বেলেছিলেন, স্পিকার তাকেই আনুষ্ঠানিকতার একটা মোড়ক দিলেন। কিন্তু তাতে ফাঁক ও ফাঁকি দুটোই এমনভাবে চোখে লাগল যে দুই ছত্র লিখতেই হলো।


নাগরিক বিদ্বেষ, তাকে আহত কিংবা খাটো করা আমাদের সংসদে বিরল নয়। তবে ভুল স্বীকার করে সংসদের দুঃখ প্রকাশ একটি বিরল ঘটনা। শিষ্টাচার অনুশীলনের প্রাথমিক পর্বের পাঠ বলে একে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। বিষয়টি অধ্যাপকের জন্য স্বস্তির বটে। কিন্তু স্পিকারের রুলিংয়ে বর্তমান সংসদের অস্বস্তি চাপা থাকেনি।
যুক্তি ও আইনগত বিচারে স্পিকারের রুলিং অনেকটা স্ববিরোধী ও পক্ষপাতদুষ্ট। অধ্যাপক সায়ীদের বিরুদ্ধে সংসদ অবমাননার অভিযোগ আনা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল সাংসদদের দ্বারা সংসদ অবমাননা। সংসদের ফ্লোরে অভিযোগ তুলতে গিয়ে সংসদীয় প্রিভিলেজ বা বিশেষ অধিকারের কী অপব্যবহার ঘটেছিল? স্পিকারের রুলিংয়ে বিষয়টি একেবারেই উল্লেখ করা হয়নি। কতিপয় পত্রপত্রিকার ভুলকে বর্ম হিসেবে ব্যবহারের যে চেষ্টা স্পিকার করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তা দুঃখজনক, পীড়াদায়ক ও অগ্রহণযোগ্য।
অধ্যাপক আবু সায়ীদের পক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান স্পিকারকে গত ৪ ও ৭ জুন দুটো পৃথক পত্র দিয়েছিলেন। প্রথমটিতে ‘গণমাধ্যমের একাংশের প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায়’ গত ৩ জুন পয়েন্ট অব অর্ডারে প্রায় ১৮ মিনিটের আলোচনায় ‘সংসদ সদস্যদের জন্য অবমাননাকর মন্তব্য’ করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়।
মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। সংসদীয় প্রতিষ্ঠিত রীতি হচ্ছে, সংসদে দেওয়া কোনো বক্তব্য অসত্য কিংবা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হলে প্রিভিলেজ কমিটি সুয়োমোটো তদন্তের জন্য গ্রহণ করতে পারে। দেশে সংসদীয় সংস্কৃতি থাকলে এ ক্ষেত্রে তা-ই হতে পারত। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতিতে সৌজন্য, শিষ্টাচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের দুর্ভিক্ষ চলছে। কদিন আগে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দুর্জন আইনজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলে আদালত সুয়োমোটো বিহিত-ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। অধ্যাপক সায়ীদ তিন আইনপ্রণেতার দ্বারা আক্রান্ত হলেন। এবং ব্যবস্থা একটা নেওয়া হলো ঠিকই, সেটা সংসদের সুয়োমোটো হতে হতেও হলো না। ডেপুটি স্পিকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্রুত দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং তা সব মহলে প্রশংসিত হলো। স্পিকারও দুঃখ প্রকাশ করলেন, সাপ মরল। কিন্তু লেজে বিষ থাকল।
যে সমাজে চেয়ে প্রায় কিছুই মেলে না, ডেপুটি স্পিকারের উদ্যোগকে টিআইবি তাই বিরাট সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে দেখেছে। স্পিকারকে দেওয়া পত্রে তাঁরা ডেপুটি স্পিকারের প্রশংসনীয় অবস্থানের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। তাঁর বক্তব্যকে ‘সংসদের অবস্থানেরই প্রতিফলন’ বলে গণ্য করেছে। এমনকি তারা ডেপুটি স্পিকারের অবস্থানের ফলে ‘টিআইবির দৃষ্টিতে বিষয়টির যথার্থ সমাধান হয়েছে’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সে জন্য সংসদের প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে। টিআইবির এই উচ্ছ্বাসে যে শিষ্টাচারের সুর তাকে আমরাও সাধু বলি।
কিন্তু রুলিং পড়ে একটা ঢোক গিললাম। টিআইবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেই হলো। কারণ স্পিকারের গলদপূর্ণ রুলিংয়ে ‘যথার্থ সমাধান’ মিলল না। আশা করি, টিআইবি এই লেখকের সঙ্গে একমত হবেন যে তাঁরা যে আশায় সংসদের এত প্রশংসা করেছিলেন, সে আশায় বালি পড়েনি ঠিকই, কিন্তু বাঁশিও বাজেনি। অধ্যাপক সায়ীদ ব্যক্তিগতভাবে একটা স্বস্তি পেতে পারেন, কিন্তু পুরোপুরি নয়। টিআইবি ‘সংসদের কার্যবিবরণীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে আলোচিত অংশ সংসদের বিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার’ জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল। তাদের কথায়, ‘যাতে ভবিষ্যতে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কোনো প্রকার বিভ্রান্তিসহ সংশ্লিষ্ট কারও মর্যাদাহানির সম্ভাবনা না থাকে।’
দুঃখের সঙ্গে বলছি, স্পিকারের রুলিং এ বিষয়ে বিভ্রান্তি ঘোচায়নি বরং আরও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বড় প্রশ্ন, সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকারসম্পর্কিত। একটি বা দুতিনটি পত্রিকা অধ্যাপকের বক্তব্য বিকৃতভাবে প্রকাশ করেছিল। এর ওপর ভিত্তি করে সাংসদ ফজলুল আজিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও মুজিবুল হক সংসদে বলেছিলেন, অধ্যাপক আবু সায়ীদ সাংসদদের ‘চোর-ডাকাত’ বলেছেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই তিনি বা কোনো নাগরিক এটা বলেছিলেন, তাহলেও কি অধ্যাপকের ‘বাড়িগাড়ি’র মতো বিদ্বেষপ্রসূত প্রশ্ন তোলার মওকা সৃষ্টি হয়? হ্যাঁ, চোর-ডাকাত শ্রেণী হিসেবে বললে সাংসদদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। সে কারণে এমন বক্তাকে বিশেষ অধিকার কমিটির মাধ্যমে সংসদে তলবের যুক্তিও বোধযোগ্য। ভালো হয়, যদি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর সম্পদের একটা বিবরণী সংসদে পাঠিয়ে দেন। আর পাল্টাপাল্টি নয়, জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে আমরা সাংসদ-মন্ত্রীসহ সব সাংবিধানিক পদধারীর সম্পদের বিবরণী জানতে চাই। বেশি না, গত সাড়ে তিন বছরে অর্জিত সম্পদেরটা দিলেই চলবে। সাংসদত্রয়ের একজন যিনি অধ্যাপকের ছাত্র, তিনিই নাকি কার্যত তাঁরই শিক্ষকের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অধ্যাপকের জন্য এটা এমনই সংবেদনশীল শিরঃপীড়া হতে পারে, যা স্পিকারের একটি আধা নৈতিক রুলিং দিয়ে মোটেই প্রশমিত হওয়ার নয়। স্পিকার কিন্তু প্রকারান্তরে একেও সাফাই দিয়েছেন গণমাধ্যমের ভুলের দোহাই দিয়ে।
স্পিকারের কথায় ভিত্তিহীন সংবাদের পাঠক বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশের কারণেই সংসদে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
‘সংবাদের যথার্থতা ও সত্যতা যাচাই না করে যেসব পত্রিকা সংবাদটি প্রকাশ করেছে তারা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে,’ সত্যি বলতে কি এটুকু পড়ার পরে আমি আশা করেছিলাম স্পিকার বলবেন, আমি অবাক হচ্ছি যে বিজ্ঞ সাংসদেরা কী করে এই সংবাদের সত্যতা যাচাই না করেই একজন বরেণ্য জাতীয় অধ্যাপক সম্পর্কে সংসদে ‘নৈতিকতা ও শালীনতা ও জনশৃঙ্খলার হানি ঘটানোতুল্য বক্তব্য দিতে পারলেন। অথচ স্পিকার তা করলেন না। থাকলেন একদেশদর্শী। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে পক্ষপাতদুষ্ট থাকলেন এই বলে যে আমি আশা করব, সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।’ স্পিকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে নিশ্চয় আমরা একমত। কিন্তু তাঁর বক্তব্য অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত এবং একপেশে হয়ে পড়ায় আমরা ব্যথিত।
ব্রিটিশ এরিস্কিন মে এবং ভারতীয় কাউল অ্যান্ড শাকধারের দুটো বই সংসদীয় বিষয়ক বাইবেল হিসেবে স্বীকৃত। স্পিকারের রুলিংয়ের সপক্ষে এই দুই বাইবেলে কোনো সমর্থন নেই। সংসদীয় বিশেষ অধিকারের ইতিহাস কেবল নাগরিক বা আদালতকে শায়েস্তা করার সঙ্গেই জড়িত নয়। ১৬৪১ সালে হাউস অব কমন্সের সিদ্ধান্ত ছিল, সংসদ কক্ষে যা বলা হবে, তার কপি মুদ্রণের জন্য বিলি করা যাবে না। স্যার ই ডারিং সংসদে দেওয়া নিজের বক্তব্যের সংকলন ছাপিয়েছিলেন। তিনি বহিষ্কৃত হন। টাওয়ারে তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়। তাঁর বইয়ের কপি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার হাউস অব লর্ডস ১৮০১ সালে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংসদীয় কার্যধারা এক্সপাঞ্জ করেছিলেন। আমরা স্পিকারের সিদ্ধান্তে পেলাম না যে অধ্যাপক সায়ীদ সম্পর্কে বলা ‘অসংসদীয় শব্দ’গুলো কী। ভবিষ্যতে কেউ তা পুনঃপ্রকাশ করতে পারবে কি না। মে লিখেছেন, ১৯৬৩ সালে এক সাংসদ অসত্য বিবৃতি দিয়েছিলেন বলে প্রমাণিত। হাউস অব কমন্সে তিনি গুরুতর সংসদ অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হন। এমন প্রতিকার কি দিতে পারে আমাদের সংসদ বা স্পিকার?
ভাবীকালের কোনো নিরপেক্ষ স্পিকার এই রুলিং সংশোধন করবেন। কারণ অসত্য বক্তব্যের জন্য সাংসদদের আর কোনো দায় থাকবে না। তাঁরা কোনো পত্রিকা বা মুদ্রিত কিছুর বরাত দিয়ে সংসদে আপত্তিকর বক্তব্য রাখতে এই রুলিংকে ছাড়পত্র হিসেবে অপব্যবহার করতে পারেন।
কাউল অ্যান্ড শাকধার স্পষ্ট বলেছেন, সংসদে দেওয়া বক্তব্যের সত্যতা ও তথ্যের দায়দায়িত্ব বক্তাকেই গ্রহণ করতে হবে। বোফর্স কেলেঙ্কারিতে ‘মধ্যস্থতাকারী’ ছিল বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন। ভারতের সংসদে তার বিরুদ্ধে অধিকার ক্ষুণ্নের অভিযোগ ওঠে। কমিটি প্রমাণ পায় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সংসদকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে পরিচালিত করতে চাননি।
বাংলাদেশেও যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন যে ওই তিন সাংসদ শুধুই পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ভ্রান্ত মন্তব্য করেননি, নন্দিত বাগ্মী-অধ্যাপক সম্পর্কে তাঁদের কারও প্রেজুডিস বা পছন্দ-অপছন্দ ছিল এবং সেটাই ব্যক্তিগত আক্রমণের কারণ তাহলে তিনিও ‘সংসদ অবমাননার’ দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। সংসদীয় অধিকারের কোনো অপব্যবহার বিশেষ অধিকার নয়, আদালতের হাত সেখানে পৌঁছাবেই।
স্পিকার আড়াই বছরের কম সময়ের ব্যবধানে নিজের সংশ্লিষ্টতায় দ্বিতীয়বারের মতো রুলিং দিতে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালের ৪ নভেম্বর স্পিকার আবদুল হামিদ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর নিজের উচ্চারিত দুটি শব্দ অসংসদীয় হিসেবে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সংসদকে ‘মাছের বাজার’ বলেছিলেন। পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, স্পিকার সংসদের সেবক মাত্র, প্রভু নন। আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন স্পিকারের রুলিং ছিল, সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির কোথাও এমন বক্তব্য রাখার বিধান নেই। তাই মন্ত্রীর বিবৃতি সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ হবে। সাংসদেরা সেদিন টেবিল চাপড়িয়ে স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। এবার আমরা এক যাত্রায় দুই ফল দেখলাম। কিংবা গুরু পাপে লঘু ব্যবস্থা দেখলাম।
স্পিকার ব্যক্তিগতভাবে আহত হয়েছিলেন বলে সেদিন লতিফ সিদ্দিকীর ‘অসংসদীয় শব্দ’ নয়, তাঁর পুরো বিবৃতি মুছে দিয়েছিলেন। অথচ আজ যেখানে পুরোপুরি অসত্য বক্তব্যের ভিত্তিতে ১৮ মিনিট এমনভাবে বক্তব্য দেওয়া হলো, যাতে সংসদীয় কার্যপ্রণালী অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। পত্রিকার বরাতে ঘটলেও এটা প্রমাণিত এবং স্পিকার দ্বারা সত্যায়িত যে পুরো ১৮ মিনিটের বক্তব্যসংবলিত কার্যবিবরণী অপ্রাসঙ্গিক ও অনৈতিক। তাই আমরা বুঝতে অক্ষম ‘অসংসদীয় শব্দ’ বলতে স্পিকার জাতিকে কী বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। কারণ কোনো কিছুই তিনি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।
আমরা সে কারণেই স্পিকারের দুঃখ প্রকাশের যে অন্তর্নিহিত চেতনা তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলব তাঁর রুলিং সংশোধনের দাবি রাখে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.