চারদিক-শহীদ মিনারে by সুচিত্রা সরকার

সূর্যটা ক্রমশ পশ্চিমে হেলে পড়ছে। দেয়ালজুড়ে কবিতা, গান, স্লোগান আর নানা রঙের ছবি। আবেগের অক্ষরে ভাষা আন্দোলনের স্মারক। রাস্তা পার হই। দেয়ালের ওপর সাইনবোর্ড—‘দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ’। তবু দেয়ালে অসংখ্য পোস্টারের প্রতিযোগিতা। পাশেই বড় আরেকটা সাইনবোর্ড।


২০১০ সালের ২৫ আগস্ট শহীদ মিনার বিষয়ে হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছিলেন। ভাবগাম্ভীর্য আর মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশ এখানে লেখা রয়েছে। সাইনবোর্ড পড়া শেষ করে লাল ইটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একপলকে দেখে নিই পুরো এলাকা। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। দুজন, তিনজন, পাঁচজন, সাতজনে বিভক্ত হয়ে আড্ডায় মশগুল সবাই। কেউ সিঁড়িতে, কেউ বেদিতে, দেয়ালে, যেখানে যেমন সুবিধা, বসেছেন নিজের মতো করে। বাদাম, সিগারেট, আইসক্রিম বিক্রেতারা তাঁদের কাছে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন।
মোরশেদ আলম ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন। মিনারের স্তম্ভটাকে নির্দেশ করে প্রশ্ন করি, এটা কি জানেন?
সেদিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন, ‘শহীদ মিনার।’
কেন এই মিনার নির্মিত হয়েছে জানেন?
‘জানুম না ক্যান? একাত্তর সালে দ্যাশ স্বাধীন করতে গিয়্যা হাজার হাজার বাঙালি শহীদ হইছিল। তাগো স্মৃতির লাইগ্যা বানাইছে।’
পাশে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছেন বাবুল হোসেন। ‘শহীদ মিনারে কি প্রায়ই আসেন?’
মুড়ি চিবানো না থামিয়েই বললেন, ‘হ্যাঁ, আসি। জায়গাটা খোলামেলা। আমার বাসা চানখাঁরপুলে। গরম লাগলেই হাওয়া খাইতে চইলা আসি।’
ঝালমুড়ি কিনতে এলেন ফারজানা আক্তার। পড়ছেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। তিনি জানান, ‘আসলে পার্কে তো ঘোরার পরিবেশ নাই। তাই এখানে আসি।’
কাদের জন্য এটা নির্মাণ করা হয়েছিল, জানেন?
‘ভাষা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশে এটা বানানো হয়েছিল।’
এগিয়ে যাই আরেকটু সামনে। শহীদ মিনারে ওঠার প্রথম সিঁড়িতে। নিজেদের ছবি তোলায় মশগুল তিন বন্ধু।
শহীদদের স্মরণ করতেই এখানে আসা?
আকরাম হোসেন বলেন, ‘আসলে দেশে থাকি না তো, তা ই এলাম। এখানের প্রকৃতি তো অনেক সুন্দর।’
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন। সবাই নার্সিং কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করি, কখনো প্রভাত ফেরিতে ফুল দিয়েছেন শহীদদের উদ্দেশে?
শফিক জানান, ‘স্কুলের মিনারে দেওয়া হতো। তবে আগামী বছর এখানেই দেব আশা করছি।’
পাশ থেকে কায়েস বলে উঠলেন, ‘শহীদ মিনার তো সব সময়ই অপরিষ্কার হয়ে থাকে। আর হকাররাও খুব বিরক্ত করে।’
এগিয়ে যাই মূল বেদির সিঁড়ি বরাবর। এখানে একটা সাইনবোর্ড, ‘জুতা পায়ে বেদিতে উঠা নিষেধ’। তবু সবাই জুতা পায়ে উঠেছেন। সে রকম একজন রুহুল আমীন। পড়ছেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘জুতা পায়ে উঠেছেন কেন?’
সপ্রতিভ উত্তর দিলেন, ‘সবাই ওঠে, তাই! আর একুশে ফেব্রুয়ারি যখন ফুল দিতে আসি, তখন তো খুলেই আসি। আজকে তো আর ওই ফেস্টিভ্যাল নেই।’
পাশেই বসে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পলাশ নাগ।
এগিয়ে যাই মূল বেদির স্তম্ভগুলোর কাছে। সাদা আর অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো পাঁচটি বেদি। মাঝে বড় স্তম্ভটি মা। দুই পাশে তাঁর শহীদ সন্তানদের অনন্তকাল ধরে রক্ষা করছেন। ছেলেরা মায়ের মর্যাদা রাখতে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগের মহিমায় মা ঝুঁকে পড়েছেন, স্নেহে। আর তাঁর এই চার সন্তানের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন কোটি সন্তানকে। এটাই শিল্পী হামিদুর রাহমানের শিল্পভাবনা।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ফুলে ফুলে ভরে যায় শহীদ মিনার। আজ বছরের বিবর্ণ একটি দিনে এখানে পড়ে আছে বাদামের খোসা আর সিগারেটের অংশবিশেষ। হাইকোর্টের রায়ে ছয়জন কর্মচারীর শহীদ মিনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকার কথা। কিন্তু পুরো শহীদ মিনারচত্বর ঘুরে কোথাও তাঁদের দেখা মিলল না।
বেদি থেকে নামতে নামতে আরেকবার দেখে নিই পুরো চত্বর। কেমন ছিল পলাশরাঙা ফাগুনের সেই দিনটি? বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি? বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিলে যোগদান? মিছিলে গুলি। শহীদ হলেন রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ইট, বালু আর সিমেন্ট দিয়ে বানানো হলো শহীদ মিনার। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউরের বাবা সেটি উদ্বোধন করলেন। দুই দিন পরই পুলিশ সেটি ভেঙে ফেলল। তারপর ১৯৫৬ সালে শিল্পী হামিদুর রাহমানের নকশায় আবার তৈরি হলো শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের পাশে থাকবে একটি জাদুঘর, পাঠাগার। এ ছাড়া ম্যুরাল নির্মাণের পরিকল্পনাও ছিল সেখানে। সহকর্মী ভাস্কর নভেরা আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করেন। তৎকালীন সামরিক সরকারের কারণে সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। তারপর মূল নকশা পরিবর্তন করে ’৬৩ সালে আবারও নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার।
সেটি একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর, ১৯৭৩ সালে আবারও মূল নকশার কিছু পরিবর্তন করে শুরু হয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ। তারপর আশির দশকে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।
বাঙালির প্রেরণার স্মারক শহীদ মিনার। তবু একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়া বাকি দিনে এই স্তম্ভগুলো বাঙালির আত্মবিস্মৃতির স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে।
সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.