সাত বিভাগে প্রথম আলোর অনুসন্ধান গ্রামে বিদ্যুৎ থেকেও নেই by অরুণ কর্মকার

‘গ্রামে লোডশেডিং হয় না। শহরে এক-দুই ঘণ্টা পর পর লোডশেডিং হয় বলে শুনি। গ্রামে ও রকম নেই। এখানে একবার বিদ্যুৎ এলে তা যেকোনো সময় চলে যেতে পারে। একবার বিদ্যুৎ গেলে কখন আসবে, তার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই।’


এই বক্তব্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ঝালকাঠির পিপলিতা গ্রামের মোকলেসুর রহমানের। গ্রামের বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল বুধবার তিনি এ কথা বলেন।
একই দিন উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার জামালপুর গ্রামের কৃষক আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুতের টাইম-টেবল নাই। কোনো দিন সকালে যায়, রাইতোত আইসে (রাতে আসে)। মাঝেমধ্যে কোনো দিন ভালোয় থাকে।’
কী বিস্ময়কর মিল দেশের দুই প্রান্তের দুই গ্রামবাসীর অভিজ্ঞতার। শুধু এই দুজন নন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার চৌমুহনী বাজারের সেলুনের মালিক টিপু মারাকের অভিজ্ঞতাও একই। তিনি জানান, তাঁদের এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। হঠাৎ করে যায়, কখনো অল্প সময়ের মধ্যে আসে। কখনো আসে দু-তিন ঘণ্টা পর।
এ অবস্থা সারা দেশের গ্রামাঞ্চল ও মফস্বল শহরগুলোর। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এ অবস্থা উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে গতকাল বুধবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত দেশের সাতটি বিভাগের ২৪টি উপজেলার প্রায় ৫০টি গ্রামে একযোগে তাৎক্ষণিক এই অনুসন্ধান চালানো হয়।
এসব এলাকার প্রায় সবই পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন। আরইবির কেন্দ্রীয় সিস্টেম ব্যবস্থাপনা থেকে বিদ্যুতের যে হিসাব পাওয়া যায়, তার সঙ্গে মাঠপর্যায়ের তথ্যের পুরো মিল রয়েছে। আরইবি সূত্র জানায়, এখন তারা চাহিদার ৬০ শতাংশের মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে। তবে গ্রামে চাহিদার ৬০ শতাংশও দেওয়া যায় না। কিছুদিন আগে পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল।
পিডিবি সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন গড়ে পাঁচ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের মতো। সেচ না থাকায় লোডশেডিং কিছুটা কম।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হলো।
গাজীপুর: সদর উপজেলার কাতলাখালী গ্রামে গত মঙ্গলবার সকাল সাতটা ২০ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়, আসে নয়টা ৪৫ মিনিটে। আবার চলে যায় ১০টায়, আসে ১১টা ৪০ মিনিটে। এরপর যায় সাড়ে ১২টায়, আসে দুইটা ২০ মিনিটে। আবার দুইটা ৪৫ মিনিটে গিয়ে আসে তিনটায়। এরপর তিনটা ১০ মিনিটে চলে গিয়ে আসে বিকেল চারটা ২০ মিনিটে। হিসাব করে দেখা গেছে, ওই দিন সেখানে বিদ্যুৎ ছিল ছয় ঘণ্টার মতো।
গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলায় প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২০৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ১২৭ মেগাওয়াট। ফলে প্রতিটি ফিডারে গড়ে ১০ ঘণ্টার মতো লোডশেডিং করতে হয়। এর মধ্যে শহর ও শিল্পকারখানায় একটু বেশি দেওয়া হয়। তাই বেশির ভাগ সময়ই গ্রাম থাকে অন্ধকারে।
গাজীপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আনোয়ার শাহাদত জানান, জেলায় ছোট-বড় চার হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে সহস্রাধিক কারখানা হুমকির মুখে। বাংলাদেশ পোলট্রি খামার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোহসিন জানান, বিদ্যুৎ না পাওয়ায় মুরগি মারা যাচ্ছে। সাড়ে ছয় হাজার খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিদ্যুৎসংকট।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: এখানে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। শিবগঞ্জে স্থাপিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রকৌশলী আবদুল আওয়াল প্রথম আলোকে জানান, সান্ধ্য পিক আওয়ারে চাহিদা থাকে ২৮ থেকে ৩০ মেগাওয়াট। পাওয়া যায় ছয়-সাত মেগাওয়াট। একেকটা লাইন বন্ধ রাখতে হয় তিন-চার ঘণ্টা করে। তবে কখনো কখনো চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো দিন সারা রাতও বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না।
কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা গোলাম রব্বানী বলেন, এক মাস ধরে অসহনীয় পরিস্থিতি। জুমার নামাজের সময়ও যখন মসজিদে বিদ্যুৎ থাকে না, তখন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মানুষের অনুরোধে অভিযোগকেন্দ্রে ফোন করলেও কেউ ফোন ধরে না। ব্যবসা-শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
খুলনা: খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটায় বিদ্যুতের করুণ চিত্র। চালনা মেরিন প্রডাক্ট লিমিটেডের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকলে কোল্ড স্টোরেজের তাপমাত্রা ঠিক থাকে না। তখন মাছের রং নষ্ট হয়। ওজন কমে যায়। বিদেশের বাজারে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়।’
ফুলতলা গ্রামের সাউথ বাংলা হ্যাচারির ব্যবস্থাপক রেজা-ই-আহমেদ বলেন, জেনারেটরে ডিজেল পুড়িয়ে অক্সিজেন তৈরি করতে খরচ বেড়ে যায়। প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার পরও ৯০ হাজার টাকার ডিজেল পোড়াতে হচ্ছে।
বদরগঞ্জ (রংপুর): আমরুলবাড়ী গ্রামের ব্রয়লার মুরগির খামারের মালিক খবির উদ্দিন বলেন, এমনিতেই প্রচণ্ড গরম, তার ওপর বিদ্যুৎ না থাকায় মুরগির বাচ্চা মারা যায়। এ জন্য খামার বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। লালদিঘী কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুৎসংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস করতে সমস্যা হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুনীল চন্দ্র রায় বলেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের অস্ত্রোপচারে বিঘ্ন ঘটে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বদরগঞ্জে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে সাত মেগাওয়াট। কয়েক দিন ধরে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে চার মেগাওয়াট। এর আগে সরবরাহ আরও কম ছিল।
সুনামগঞ্জ: সুরমা ইউনিয়নের বেড়িগাঁও গ্রামের শিক্ষক আবদুস সোবহান বলেন, ‘সরকার শুধু বলে, বিদ্যুতের কোনো সমস্যা নাই, উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু আমরা তো তার কোনো লক্ষণ দেখি না।’
ইব্রাহীমপুর গ্রামের পোলট্রি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান তাঁর খামারের চার হাজার মুরগির বাচ্চা বাঁচাতে জেনারেটর কিনেছেন। মঙ্গলকাটা বাজারের শরীফ পোলট্রি ফার্মের মালিক কবির হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি, লোডশেডিংয়ের একটা সময় থাকে। কিন্তু এখানে কোনো টাইম-টেবল নাই।’
বাঘাইছড়ি (রাঙামাটি): গত মঙ্গলবার ২১ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে এখানে। সারা রাত বিদ্যুৎ ছিল না। একবার গেলে কখন আসে, তা ঠিক থাকে না। এখানে চাহিদা মাত্র এক মেগাওয়াট। সমস্যা আছে ভোল্টেজেরও।
উপজেলা সদরের ব্যবসায়ী শামিউল আলম বলেন, ‘সারা দিন বিদ্যুতের অস্বাভাবিক যাওয়া-আসায় আমরা অতিষ্ঠ। আবার রাতেও বিদ্যুৎ থাকে না। এ গরমে দিনভর কাজ করে রাতে ঘুম হয় না।’
রূপকারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পারদর্শী চাকমা বলেন, লো-ভোল্টেজের কারণে দিনে কোনো ফ্রিজও চালু থাকে না। অনেকের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে।
দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি): গত মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করেছে ১০ বার। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত একটা পর্যন্ত সাতবার। রাত একটায় বিদ্যুৎ যাওয়ার পর এসেছে বুধবার সকাল সাড়ে আটটায়। আর লো-ভোল্টেজের সমস্যা তো আছেই।
দীঘিনালা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজীব ত্রিপুরা, হাচিনসনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবপ্রিয় বড়ুয়া ও ছোট মেরুং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান বলেন, বিদ্যুতের সমস্যার কারণে বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাব সম্পূর্ণ বন্ধ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা পলাশ নাগ বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় শ্বাসকষ্টের রোগীর নেবুলাইজার মেশিন, শিশুদের কফ অপসারণের সাকার মেশিন চালানো সম্ভব হয় না।
দীঘিনালা উপকেন্দ্রের আবাসিক প্রকৌশলী যত্নমানিক চাকমা বলেন, ‘সব গ্রাহকের মতো আমরাও দুর্ভোগে পড়েছি। আমার নিজের বাসার মোটরও চলছে না।’
ঝালকাঠি: ‘দিন-রাইতের ২৪ ঘণ্টার ১৫-১৬ ঘণ্টাই কারেন্ট থাহে না। কহন কারেন্ট আইবে আর কহন যাইবে, হেয়া একমাত্র আল্ল্লায়ই জানে।’ কথাগুলো বলেন নলছিটি উপজেলার লক্ষ্মণকাঠি গ্রামের গৃহবধূ শারমিন সুলতানা।
ঝালকাঠি পল্ল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘পিডিবির কাছ থেকে আমরা যতটুকু বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাই, তা সমহারে বিভিন্ন এলাকায় বণ্টনের চেষ্টা করি। অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে সংকট আরও বেশি হয়।’
নিয়মিত বিদ্যুৎ না পাওয়ায় ঝালকাঠির লবণ ও ময়দার মিলমালিকেরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
আইসক্রিম ও বরফ কারখানার মালিক অসীম দাস বলেন, ‘ঝালকাঠির মতো লোডশেডিংয়ের খবর কোথাও পাই না। আমার বরফকল প্রায় বন্ধের পথে।’
পটিয়া (চট্টগ্রাম): হুলাইন কলেজ রোডের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাহেদ বলেন, দিন-রাত কয় ঘণ্টা লোডশেডিং হবে, তার হিসাব নেই। একবার চলে গেলে দু্ই-তিন ঘণ্টা দেখা মেলে না। কাজি অফিসের অফিস সহকারী মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘কখনো রাতে টানা বিদ্যুৎ থাকে না। আবার এই আসে এই যায় অবস্থার কারণে সারা দিন পরিশ্রম করে রাতে অসহ্য গরমের জন্য ঘুমাতে পারি না।’
এলাকাবাসী বলেন, প্রায় দিনই তিন-চার ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না। স্থানীয় কহিনূর অ্যাপারেল প্রতিষ্ঠানের সূত্র জানায়, তাদের দৈনিক ১১ হাজার টাকার ডিজেল কিনতে হয়।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ পটিয়া সদর দপ্তরের মহাব্যবস্থাপক মো. ইউসুফ বলেন, ৫৭ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ছিল ২৪ মেগাওয়াট।
নীলফামারী: সেচ মৌসুম শেষ হওয়ায় চাহিদা কমলেও কমেনি বিদ্যুতের আসা-যাওয়া। লোডশেডিংয়ের নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। গত মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে গতকাল সকাল ছয়টা পর্যন্ত নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের শালনগ্রাম ও গোলনা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ এলাকায় সরেজমিনে বিদ্যুতের করুণ চিত্র পাওয়া যায়।
কালীগঞ্জের একটি কোল্ড স্টোরেজের পরিচালক তৌহিদ রফিক চৌধুরী বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে আমরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ভুট্টা ব্যবসায়ী মোনায়েম হোসেন বলেন, এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ-চালিত মেশিনে ভুট্টা ভাঙানো ও শুকানোর কাজ চলছে। যখন-তখন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নীলফামারী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম আবুল মুমিত চৌধুরী বলেন, ‘এখন নীলফামারী জেলায় পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ মেগাওয়াট। পিক সময়ে পাচ্ছি আট-নয় মেগাওয়াট।’
এ ছাড়া সিলেট, মৌলভীবাজার, পাবনা, পঞ্চগড়, মানিকগঞ্জ, বরগুনা, হবিগঞ্জ, লালমনিরহাট, সাতক্ষীরা ও শিবগঞ্জ (বগুড়া) থেকেও এ বিষয়ে প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এসব প্রতিবেদনেও একই চিত্র ফুটে উঠেছে।
প্রতিবেদনগুলো পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা।

No comments

Powered by Blogger.