চার দিক-তবু হেঁটে চলা... by মীর রাব্বি

পরিবারের কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হননি। প্রতিদিন পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশন চ্যানেলে দেশের বিভিন্ন স্থানের সড়ক দুর্ঘটনা, মানুষের মৃত্যু, স্বজনের আহাজারি তাঁকে ভীষণভাবে মানসিক পীড়া দিচ্ছিল। ভাবলেন ভিন্ন কিছু করার কথা। একটা সময় আরিফুলের এ ভাবনাটা জেদে পরিণত হয়।


সিদ্ধান্ত নিলেন, রাস্তায় নামবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএস শেষ বর্ষে পড়ুয়া আরিফুল ইসলাম নামের এই তরুণ করলেনও তাই।
‘নিরাপদ সড়কের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে আছে, আর জ্যামের সঙ্গে সময়—দুটিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’ বললেন আরিফুল ইসলাম। আর সে কারণেই তিনি হাঁটছেন মাতৃভূমির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই, জ্যামমুক্ত রাজধানী চাই, পায়ে পায়ে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ’ লেখা একটি ব্যানার তাঁর রংচটা গেঞ্জির সামনে সেঁটে নিয়েছেন ২৬ আগস্ট। সেটা বুকে নিয়েই পায়ে পায়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর হয়ে ঢাকা এলেন ১৬ সেপ্টেম্বর। তাঁর উৎসাহের কোনো শেষ নেই।
অনেক চেনা-অচেনা মানুষকে বলেছিলেন, ‘আমি নিরাপদ সড়ক চাই—এই স্লোগান নিয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চাই, সচেতন করতে চাই, আমি তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাব, আমার পাশে দাঁড়ান, কিন্তু তেমন কেউই উৎসাহ নিয়ে পাশে দাঁড়ায়নি আমার। এমনকি এও বলেছে, আমি যেন অভিযান না চালাই। তার পরও অনেকটা মনের জোরে আমি সংকল্পে অটুট থাকি। তবে সব সময় আমার পরিবার আমাকে শক্তি ও সাহস জুগিয়ে এসেছে।’
ফল বিক্রি করে, ট্যাক্সিক্যাব চালিয়ে, আরও কিছু কাজ করে জমানো টাকা এবং মায়ের দেওয়া কিছু টাকা নিয়ে আরিফুল হাঁটতে শুরু করলেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরের বাংলাবান্ধা অর্থাৎ তেঁতুলিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে। এ কারণে অবশ্য ঈদের আনন্দ তাঁর পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়নি। বরং প্রচণ্ড ক্ষুধায় তাঁর ঘুম ভেঙেছিল ঈদের দিন সকালে। পাউরুটি আর কলা ছাড়া অন্য খাবার মেলেনি সেদিন। তবু লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাড়না ছিল ক্ষুধার চেয়ে বেশি।
‘সবকিছুর পরও এবারের ঈদটা ছিল আমার জন্য অন্য রকম। কারণ ওই দিন আমার যমুনা সেতু পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যাবার কথা। কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্রও মিলেছিল, তা নিয়ে এগিয়ে চললাম।’ আরিফুল বললেন, ‘জীবনে অনেকবার এই সেতুর ওপর দিয়ে গেলেও এবারই প্রথম আমি হেঁটে পার হলাম। তবে পার হওয়ার পর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’ কারণ, যমুনা সেতু পার হওয়ার পরই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দুজন মানুষের মৃতদেহ দেখলেন রাস্তায় পড়ে থাকতে।
এই সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান নিয়েই হাঁটছেন তিনি, উদ্বুদ্ধ করছেন রাস্তার পাশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চালক-যাত্রী সবাইকে। তাই চলার শক্তি যেন আরও বেড়ে গেল তাঁর। আরিফুল তাঁর দীর্ঘ পথের এটুকু আসতে এ রকম দুর্ঘটনায় মৃত মানুষ দেখেছেন নয়জন, আহত হতে দেখেছেন ২২ জনকে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, বাজারে বাজারে সাধারণ মানুষের স্বাক্ষর গ্রহণ করতে করতে, প্রত্যেক জেলা-থানার কর্মকর্তার স্বাক্ষর করা কাগজ নিয়ে আজও হাঁটছেন আরিফুল ইসলাম। ‘পেট্রল স্টেশনের মানুষগুলো আমায় ভিখিরি ভাবে।’ একটু অভিমান করে বললেন তিনি। কিন্তু গ্রামের, রাস্তার, হাটের, বাজারের সরল মানুষগুলোর ভালোবাসা যেন সব ভুলিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এক বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘আমি রাস্তার পাশে বইয়া দোয়া করি, যেন মায়ের পুত মায়ের কাছে পৌঁছাইতে পারে।’ আরিফুলও তা-ই চান।
আরিফের হিসাবমতে, এ পর্যন্ত হাত মিলিয়ে কথা হয়েছে তাঁর প্রায় ৩০ হাজারের মতো মানুষের সঙ্গে, আর সচেতনতার কথা জানাতে পেরেছেন পাঁচ লাখ মানুষকে। তেঁতুলিয়া থেকে ঢাকা আসার পথে রাতে আশ্রয় মিলেছে খুব সাধারণ অচেনা কিছু মানুষের ঘরে, অথবা স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া জায়গায়। খাওয়া রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানে। প্রতিদিন গড়ে ২৩ কিলোমিটার করে হেঁটেছেন। কখনো আরও বেশি। তবে এলেঙ্গা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে কালিয়াকৈর পর্যন্ত টানা হেঁটেছিলেন ৩৫ কিলোমিটার। প্রবল বৃষ্টিতে তাঁকে থামতে হয় মাঝেমধ্যে। কেননা, সাধারণ মানের একমাত্র জুতা জোড়া পানিতে ভিজে একাকার হলে বড্ড ঝামেলা হয়ে যাবে।
দীর্ঘ এ যাত্রাপথে আরিফুল হাইওয়ে পুলিশের খুব একটা তৎপরতা দেখেননি। তিনি তাঁর এই পাড়ি দেওয়া পথে ৮০টি স্থানকে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘ছয়টির মতো ব্রিজে প্রতি সপ্তাহে পাঁচটির মতো দুর্ঘটনা ঘটে।’ আরিফুল বলেন। সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে জায়গাগুলো নিরাপদ হবে বলে মনে করেন তিনি। হাইওয়ে টার্নিংগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
আরিফুল বলেন, ‘আমাদের চালকেরা বেশ দক্ষ, তবে বেপরোয়া, যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।’ সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে কিছু বিষয় তিনি চিহ্নিতও করেছেন। যেমন, পরিবহন মালিককে সৎ হতে হবে, ভালো রাস্তা হতে হবে, পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে, দক্ষ ও শিক্ষিত চালক হতে হবে। তবে সব বিফলে যাবে যদি সর্বস্তরের মানুষ সচেতন না হন।
আরিফুল হয়তো এখন টেকনাফের পথে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে হাঁটছেন; কখনো লোকালয়ে, আবার কখনো শুধুই এঁকেবেঁকে হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় রাস্তায়। তাঁর এই হেঁটেচলা, স্বপ্ন সত্যি হতে পারে, যদি আমরা সচেতন হই। কেননা, দায়িত্বটা আমাদেরই বেশি।

No comments

Powered by Blogger.