সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য-নারীর উন্নয়ন কতটুকু হলো? by জোবাইদা নাসরীন

পৃথিবী থেকে চরম দারিদ্র্য-ক্ষুধা নির্মূল, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, নারী-পুরুষের সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি, এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধ, টেকসই পরিবেশ ও উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারি তৈরির লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে, সময়-নির্ধারিত ও পরিমাপযোগ্য পন্থায় আটটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রণীত হয় ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’।


বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৬৫তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন এবং এই ১০ বছরের মধ্যে শিশুমৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্য অনুকরণীয় হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ পদক গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের যেগুলোর সঙ্গে নারীর প্রশ্ন সম্পৃক্ত, সেগুলো কী অবস্থায় আছে?
এই আটটি লক্ষ্যের মধ্যে তিন ও চার নম্বর লক্ষ্য দুটি নারীকে ঘিরে, যদিও প্রতিটি লক্ষ্যের সঙ্গেই লিঙ্গীয় ভাবনা এবং নারী জড়িত হওয়ার পরও শুধু দুটি লক্ষ্যের মধ্য দিয়ে নারীর লক্ষ্যকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং অনেক নারীবাদী সমালোচক বলছেন, এর মধ্য দিয়ে এক ভাবে আড়াল করা হয়েছে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদকে (সিডও সনদ)। তাঁরা আরও বলেন, এতে আরও উপেক্ষিত হয়েছে নারীর পুনরুৎপাদন ও যৌন অধিকারের বিষয়টিও।
আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে চলা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতিবিষয়ক আমাদের সরকারি প্রতিবেদনে (২০০৮) তিন নম্বর লক্ষ্য অর্থাৎ নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন অর্জনের ক্ষেত্রে তিনটি সূচকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাত, দ্বিতীয়টি অকৃষি খাতে মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং শেষেরটি জাতীয় সংসদে নারী আসনের অনুপাত।
প্রথম সূচকটির ক্ষেত্রে বলা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সন্দেহাতীতভাবেই সমতা অর্জন করেছে। তবে পরে বিদ্যালয় থেকে মেয়েশিশুর ঝরে পড়ার হার হচ্ছে ২৭ শতাংশ, যা ছেলেদের ঝরে পড়ার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ (সূত্র: বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ)। এই ঝরে পড়ার পেছনের কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, বাল্যবিবাহ এবং ‘ইভ টিজিং’ কাজ করছে। গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় ৭ শতাংশ নারীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে বখাটেদের উৎপাতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন পাবলিক পরিসরে নারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করার জন্য যৌন হয়রানিনিরোধ আইনের কথা বারবার এলেও এখনো সেটি করা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ বন্ধ করা ছাড়া সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের দুই ও তিন নম্বর লক্ষ্য অর্জনে অর্থবহ ফল পাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয় সূচকে অকৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি, যদিও গত ১০ বছরে অকৃষি খাতের তুলনায় কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কৃষিকাজে ১২টি ধাপের মধ্যে নয়টি ধাপে নারীর প্রত্যক্ষ এবং তিনটিতে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ থাকলেও সরকারি কোনো দলিলপত্রে এখন পর্যন্ত নারীর এই শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি। ঠিক একইভাবে মৎস্য চাষে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও মৎস্যচাষি হিসেবে কাগজপত্রে নারীর পরিচয় তৈরি হয়নি। সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত মোট কৃষি উপকরণের মাত্র ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ পেয়েছেন নারীরা এবং সরকারের দেওয়া কৃষি প্রশিক্ষণেও কোনো নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না (চৌধুরী জহির, ২০০৫)। তাই সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। ২০০৮-এর প্রস্তাবিত নারীনীতিতে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল, কিন্তু সেটি সেখানেই থেমে আছে। আশা করি, এ বিষয়ে সরকার অচিরেই জোরালো অবস্থান নেবে এবং এর মাধ্যমে ত্বরান্বিত হবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছানো।
বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার মাত্র ২৬ শতাংশ, যদিও তা গত ১৫ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। এই হার বৃদ্ধি করতে সবচেয়ে বেশি অবদান পোশাকশিল্পের নারীদের, যদিও এটি কেবল এ খাতের স্থায়ী শ্রমিকের হিসাব। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক খাতে স্বীকৃতি না পাওয়া নির্মাণশ্রমিক এবং ট্যানারি নারীশ্রমিকের শ্রমেরও হিসাব নেই এই পরিসংখ্যানে। এর পাশাপাশি এখন পর্যন্ত কত নারী স্বাস্থ্যঝুঁকি, মজুরিবৈষম্য, যৌন হয়রানি, কাজের অনুকূল পরিবেশের অভাবে শ্রমবাজার থেকে চলে গেছেন, তার কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি পরিসংখ্যান নেই। শ্রমবাজারে নারীর কাজের প্রতিকূলতাকে চিহ্নিত করতে না পারলে এবং এই বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো যাবে না। এ ক্ষেত্রেও বাকি পাঁচ বছরে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে কি না, বলা কঠিন।
এর পাশাপাশি ঘরে ও বাইরে নিরাপত্তাহীনতাও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এই নিরাপত্তাহীনতাবোধ বাংলাদেশের সব নারীর জন্য এক রকম নয়। বাঙালি মুসলিম, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী কিংবা দলিত নারীর অনিরাপত্তাবোধকে একভাবে দেখা যাবে না। সবার নিরাপত্তার সূচকগুলো আলাদাভাবে পরিমাপ করতে হবে এবং তার নিরিখেই ক্ষমতায়নের সুযোগ হবে। এর বাইরে দরিদ্র নারী, প্রবীণ নারী, প্রতিবন্ধী নারী, দলিত নারী, যৌনকর্মী, বেদে নারীসহ সমাজের বিভিন্ন অস্পৃশ্যতার শিকার নারীদের জন্য অনুকূল শ্রমবাজার তৈরি করতে হবে।
তৃতীয় সূচকটির সাফল্য পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আশাব্যঞ্জক। গত ১০ বছরে সরাসরি আসন এবং সংরক্ষিত আসনে নারী প্রতিনিধি বেড়েছে। স্থানীয় সরকার পরিষদে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে লক্ষ্যে কতটা পৌঁছাতে পারবে, সেটি নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছা এবং পুরুষতান্ত্রিক গাঁথুনির পরিবর্তনের ওপর। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বড় উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের পাঁচ নম্বর লক্ষ্য ছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৫৭০ (১৯৯০ সালের তথ্য) জন থেকে কমিয়ে ১৪৪ জনে নামিয়ে আনা। শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও মাতৃমৃত্যুর হার তেমন কমেনি। এ লক্ষ্য অর্জনে বেশ অনেকটাই পেছনে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এখনো এক লাখ প্রসূতি মায়ের মধ্যে ৩৫১ জনই প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেন। সেই হিসাবে দেশে প্রতিবছর প্রসবকালেই প্রায় ২০ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও প্রায় ছয় লাখ নারী প্রসবজনিত নানা সমস্যায় ভোগেন। এভাবে চলতে থাকলে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার দাঁড়াবে প্রতি লাখে ৩১০ জন (মজুমদার: ২০১০), যা কোনোভাবেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে পৌঁছাবে না।
এগুলোর পাশাপাশি বাকি পাঁচ বছরে সরকারকে আরও কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা সরাসরি নারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেগুলো বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করতে হবে। আবাদি জমি নষ্ট করে চিংড়ি চাষে পরিবেশ ও সামাজিক যে বিপর্যয় চলছে, তার প্রধান শিকার হচ্ছে দরিদ্র নারীরা। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। নারীর কাছে যেন তথ্য সহজলভ্য হয়, সে বিষয়েও নজর দেওয়া জরুরি। প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোতে (টেলিভিশন, খবরের কাগজ, রেডিও) যাদের প্রবেশাধিকার নেই, তাদের জন্য তথ্য প্রচারের বিকল্প মাধ্যম খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে নারীর উন্নয়নে এসব বিষয় বিবেচনা করা গেলে কার্যকর অগ্রগতি সূচিত হবে আর সবারই এতে অংশীদারি তৈরি করা যাবে বলে আশা করা যায়।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.