পদ্মা সেতু প্রকল্প-দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংক আগ্রহী নয়

বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, যেকোনো নির্মাণকাজে স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। কেননা, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ কোনো কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংক সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী নয়। তাই সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক এখন আর সক্রিয় নয়। সরে এসেছে।


গোল্ডস্টেইন আরও বলেন, এটা বাংলাদেশের জন্য ট্র্যাজেডি যে তার প্রচুর অবকাঠামো বিনির্মাণ ও উন্নয়নের প্রয়োজন থাকার পরও এখানেই নানা অনিয়ম হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন কোনো কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়মের সাক্ষ্য-প্রমাণ পাই, তখন আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আমাদের অর্থ ও সম্পদ রক্ষার জন্য আমরা সেখান থেকে সরে আসি। তবে এটি একই সঙ্গে সুশাসনের দিকে সরকারের মনোযোগও বাড়ায়।’
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বুধবার আমেরিকা চেম্বারের (অ্যামচেম) মধ্যাহ্নভোজসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে গোল্ডস্টেইন এসব কথা বলেন। অ্যামচেমের সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম এতে সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত ভাষণ দেন অ্যামচেমের নির্বাহী পরিচালক এ গফুর।
অ্যালেন গোল্ডস্টেইন এ সময় আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকাসহ সব সহ-অর্থায়নকারী পারস্পরিক বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করতে আমরা আশাবাদী। আর পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংক এখনো স্থগিত করেনি বা বাদ দিয়ে দেয়নি। এটার ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’
গোল্ডস্টেইন আরও বলেন, পদ্মা সেতুর মতো উচ্চমানের সেতু কোনো ধরনের দুর্নীতি ছাড়াই নির্মিত হবে, এটাই প্রত্যাশিত। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থায়নের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুসংশ্লিষ্ট অংশ ২০ ভাগ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে আছে শিক্ষা, পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তাসহ ৩৩টি বিভিন্ন খাত, যেগুলোতে বিশ্বব্যাংক সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অনীহার প্রসঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন বক্তার মন্তব্য ও প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে গোল্ডস্টেইন এসব কথা বলেন।
বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক তাঁর বক্তৃতায় দুর্নীতি ও প্রতারণার ঝুঁকি রোধে বিশ্বব্যাংকের তিনটি কৌশলের কথা উল্লেখ করে বলেন, সুরক্ষা (সেফগার্ড) কৌশলের আওতায় দুর্নীতি-প্রতারণায় যুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আর উচ্চ ব্যয়নির্ভর কর্মকাণ্ডে এই ঝুঁকির মাত্রা বেশি থাকে। গোল্ডস্টেইন আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিটি প্রকল্পের জন্যই আলাদা কর্মপরিকল্পনা করছি, যেন দুর্নীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়।’
সভাপতির ভাষণে আফতাব-উল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে, আমরা মনে করি সরকার সেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং বিষয়টির একটি সুষ্ঠু সুরাহা হবে। আশা করি, এর ফলে বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্তির আগেই আমরা সুন্দরভাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়া দেখতে পাব।’ তিনি আরও বলেন, সবকিছুরই একটি সময় আছে। আর একটি জাতির জন্য দেরি হওয়া মানে আসলে পরাজিত হয়ে যাওয়ার শামিল।
অ্যামচেমের সভাপতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক সংঘাত চলতে থাকলে মানুষ রাজনীতির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য সমস্যা বয়ে আনবে। কাজেই রাজনৈতিক সংঘাতের নিরসন করতে হবে।
প্রশ্নোত্তরপর্বে আবদুল মোনেম গ্রুপের পরিচালক মাঈনউদ্দিন মোনেম বলেন, বাংলাদেশের মানুষের দিকে তাকিয়ে বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন করা উচিত।
দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে বিশ্বব্যাংকের অনীহার দিকে ইঙ্গিত করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘মনে হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলতে চাইছে।’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, স্বচ্ছতা ও তথ্যের উন্মুক্ততা চর্চা বিশ্বব্যাংকের জন্য নতুন বিষয়। তাই এটা নিয়ে গড়বড় হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। তিনি একাধিক প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হওয়ারও উল্লেখ করেন।
ইফতেখারুজ্জামান আরও প্রশ্ন রাখেন, ‘বিশ্বব্যাংক যদি সত্যিই স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততার চর্চায় বিশ্বাস করে, তাহলে কেন তার দায়মুক্তি সুবিধা নিতে হবে?’
এ প্রশ্নের জবাবে গোল্ডস্টেইন বলেন, ‘দায়মুক্তি এককভাবে বাংলাদেশে নয়, বরং বিশ্বব্যাপীই বিশ্বব্যাংক এই সুবিধা পায়।’

No comments

Powered by Blogger.