ভার্চুয়াল রিয়ালিটি by কবির হুমায়ূন

নন্দ-বিষাদে ভরেছে মন। নাকি আনন্দে ভরেছে মন। অন্ধকার মধ্যরাতে আকাশের তারা খসে কোথাও হারিয়ে যেতে থাকলে আনন্দ-বিষাদ দুই-ই কাজ করে। বিস্ময়ের আনন্দ। হারিয়ে যাওয়ার বিষাদ।' ফেসবুকের ইনবঙ্ েএই লাইন কটা পাঠিয়েছে রিকি। কেন পাঠিয়েছে_এই প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই। রিকি কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। মাঝেমধ্যে এমন কিছু লাইন পাঠায় শুধু। বছরখানেক আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট থেকে রিকিকে অ্যাড করে নিলে সংক্ষিপ্ত জবাব আসে; ধন্যবাদ। রিকি কখনো ফেসবুকের দেয়ালে কিছু লেখে না।


রিকির অ্যাকাউন্টে ছবির জায়গায় স্থান করে নিয়েছে শীত মৌসুমের ঝরাপাতা। ওর প্রোফাইলটা দারুণ ইমপ্রেসিভ। কিন্তু গত এক বছরে রিকি একবারও ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বাস্তবে পা দেয়নি। রিকি কে? কেন মাঝেমধ্যে ইনবঙ্ েএ ধরনের কথা লিখে পাঠায়? ইচ্ছা হলে যেকোনো সময় ওকে রিমুভ কিংবা ব্লক করা যায়। তারও তো প্রয়োজন নেই। রিকি ক্ষতিকারক কিছু নয়। বরং মাঝেমধ্যে ওর পাঠানো লাইনগুলো পড়তে মন্দ লাগে না। মোবাইলে জলপ্রপাতের শব্দ হতে থাকলে ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে নেয় অনিম। অফিস থেকে ফিরলে অচেনা আর অপ্রয়োজনীয় কোনো কল এলে অনিম রিসিভ করে না। ঘণ্টাখানেক হলো বিছানায় গড়াগড়ি যেতে যেতে ল্যাপটপ নিয়ে এটা-সেটা করছিল। বাসা আর অফিস। জীবন যেন এতেই আটকে আছে।
_তুই ফোন বন্ধ করে রাখিস কেন?
_কই, না তো।
_৪টার পর থেকে আমি সাতবার ফোন করেছি। প্রত্যেকবার বন্ধ পেয়েছি।
_ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই ফোন অন করেছি।
_ঘুম! এই সন্ধ্যায় ঘুম?
_না হয় কী করব! সময় কাটে না। ঘুমাতে ভালো লাগে।
_বাইরে যেতে পারিস না! হাঁটাহাঁটি করতে পারিস না!
_পারি। কিন্তু ভালো লাগে না। ঘর আমার অনেক প্রিয়।
_এখন কী করছিস?
_তোর সঙ্গে কথা বলছি।
প্রীতি আর কথা বাড়ায় না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, 'শোন, আজ আমি তোকে ফোন করব ঠিক রাত ১২টা এক মিনিটে। যতক্ষণ ইচ্ছা কথা বলব। আমার কথা শুনতে হবে তোকে। আমার ধারণা, তোর উপকারে দেবে।' এরপর 'এখন রাখলাম' বলে প্রীতি ফোন কেটে দেয়। অনিম রান্নাঘরে পা বাড়ায়। চুলায় গরম পানি উঠিয়ে মগ পরিষ্কার করে। চা পাতা আর চিনি একসঙ্গে গরম পানিতে মিশিয়ে দেয়। মগ ভর্তি চা নিয়ে শোবার ঘরে সোফায় বসে। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রথমে ব্যক্তিগত, তারপর অফিশিয়াল_দুটি ফোনই বন্ধ করে দেয়। আহ! অনিমের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। হঠাৎ মনে হলো, আজ তো রাশিফলটা দেখা হলো না। এখন আর দেখেই বা কী হবে। আর চার ঘণ্টা পর তো পরের দিন শুরু হবে। তার পরও অনিম বসা থেকে ওঠে। ডাইনিং টেবিলে রাখা দিনের পত্রিকায় রাশিফল খোঁজে। বৃষ (২১ এপ্রিল-২১ মে) : চাকরির জন্য বিদেশে আবেদন করে কেউ কেউ ইতিবাচক সাড়া পেতে পারেন। বেকারদের কারো কারো জন্য দিনটি বিশেষ শুভ। কর্মস্থলে অন্যের সহযোগিতা পাবেন। বিয়ের আলোচনায় অগ্রগতি হবে।
বাহ! বেশ তো। চাকরির জন্য বিদেশে আবেদন করলে ইতিবাচক সাড়া! ম্যাডাম ইয়োকোঙ বেশ কয়েকবার বলেছিলেন একটা আবেদনপত্র পাঠাতে। অনিম সামান্যও পাত্তা দেয়নি। তোমাতে করিব না কাজ_মনে মনে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত একমুহূর্তের জন্যও ভুলে যায়নি। বহুদিন পর ইয়োকোঙয়ের কথা মনে পড়ায় একটু অবাক লাগল। পাপাওশানের হু হু বাতাসের ঝাপটা যেন শিরশিরে কম্পন ধরিয়ে দিয়ে গেল মনে। প্রীতি রাত ১২টা এক মিনিটে ফোন করে যখন আবার ফোন বন্ধ পাবে, কুত্তা, হারামি_এসব গালাগাল করতে করতে একটা মেসেজ পাঠাবে, 'তোর মরা মুখও আমি কখনো দেখতে যাব না।' অনিম এসব কথায় অভ্যস্ত। তার পরও অস্ফুট স্বরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মুনিয়া! লাল টুকটুক মুনিয়া, অবাক তোমার দুনিয়া। সেদিন মধ্যরাতে ১২০৩ রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার করিডরে হাঁটাহাঁটি করতে করতে রাতের পেইচিংয়ের ওপর নজর দিয়েছিল অনিম। নাহ! দিনের মতোই পেইচিংয়ের আকাশ রাতেও মন খারাপ করে থাকে। কোথাও একটি তারাও চোখে পড়েনি। ওয়াঙ তান হোঙ তাকে নিয়ে গিয়েছিল পাপাওশানে ইয়োকোঙয়ের কাছে। তারপর আরো বেশ কয়েকজন বন্ধু হয়েছিল অনিমের। অবাক লেগেছে, যাদের সঙ্গেই কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তাদের নামের আগেও ওয়াঙ বলবৎ রয়েছে। যেমন_ওয়াঙ ইয়োছিয়ান, ওয়াঙ হাঁ, ওয়াঙ হাইয়ুন ইত্যাদি। সেই দিনগুলোর পাট চুকে গেছে। হলে অনেক কিছু হতে পারত। যা হয়নি, তা এখন আর হলেও সম্ভব না। অনিম মনে করার চেষ্টা করে। নান লু কু শিয়াঙয়ের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওয়াঙ তান হোঙ মোবাইলে তার বন্ধুকে বলে, 'থা দা শিনছিঙ পু হাও।' অর্থাৎ অনিমের মন খারাপ। সে আর ফিরবে না সেদিন। অনিম তার নাম দেয় মুনিয়া।
_মুনিয়া, আমরা কী করব?
_আমরা আজ ছিয়ান মেনে গিয়ে চেঠ্রোয়ান প্রদেশের নুডলস খাব।
_তারপর কী করব?
_তারপর তোমাকে রাতের তিয়ান আনমেন স্কয়ার দেখাব।
_তারপর?
_তারপর তোমাকে নিয়ে যাব সান লি থুনে।
_সেখানে কী?
_সান লি থুন হলো ডিসকোপাড়া। দুজনে ডিসকোতে নাচব।
_আমি নাচতে জানি না।
_আমি শিখিয়ে দেব। তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
_আমার মন খারাপ হয়েছে, সে কথা তোমাকে কে বলেছে?
_আমার মনে হয় আমি জানি।
_তুমি কিছুই জানো না।
_কিন্তু আজ আমার মন খারাপ। আমার জন্য হলেও তোমার যাওয়া দরকার।
_তোমার মন খারাপ হলেই কি তুমি ডিসকোতে যাও?
_মাঝেমধ্যে। একা একা ডিসকোতে ভালো লাগে না। তবে আমার মন খারাপ হলে কোথাও মাঠের মধ্যে চলে যাই। অনেকক্ষণ ব্যায়াম করি। তারপর পেট ভরে খাই। মন ভালো হয়ে যায়।
_তার মানে তোমার মন নেই। শরীর আছে। তোমার সমস্যা শরীরে। শরীরের সমস্যা ফুরালে তুমি ফুরফুরে হয়ে যাও।
হঠাৎ এমন কথায় মুনিয়া ঠায় তাকিয়ে থাকে অনিমের মুখের দিকে। চোখে রাজ্যের বিস্ময়। যেন চোখগুলোকে কোথাও লুকাতে পারছে না। না পেরে রাস্তার মাঝখানেই অনিমকে জড়িয়ে ধরে পিঠে খাবলা মারতে থাকে। মুনিয়ার মসৃণ স্তন অনিমের বুক লেপ্টে ধরে। অপ্রস্তুত অনিম জড়িয়ে থাকা মুনিয়াকে নিয়ে রাস্তার পাশে যেতে চায়। মুনিয়া তার শরীরের পুরো ভর অনিমের ওপর অর্পণ করে।
দুই.
এটা হলো মনুমেন্ট। পূর্ব পাশের ওই ভবনটা হলো মাও সে তুং মেমোরিয়াল হল। এই যে দক্ষিণ পাশের বিশাল ভবনটা দেখছ, এটি পিপলস হল। তিয়ান আনমেন স্কয়ারের বিশাল বুকজুড়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব অনিমকে বলছিল মুনিয়া। রাত ১০টায়ও বহু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছিল স্কয়ারে। মুনিয়া অনিমের বাঁ হাতের ভেতর নিজের ডান হাতটা ঢুকিয়ে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে আরো বলে, জানো, মনুমেন্টের ওই পাশটায় প্রতিদিন ভোরে সামরিক বাহিনীর লোকরা গার্ড অব অনার করে আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। আবার সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে গার্ড অব অনারের মাধ্যমেই পতাকা নামিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় বহু মানুষ একত্র হয় এই দৃশ্য দেখার জন্য। আর অক্টোবরের ১ তারিখে তো তুলকালাম কাণ্ড। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ এই স্কয়ারে আসে সামরিক কুচকাওয়াজ দেখতে। কথায় কথায় অনিম আর মুনিয়া চলে আসে স্কয়ারের পশ্চিম পাশটায়। স্কয়ার ঘেঁষেই উত্তর-দক্ষিণে সুপ্রশস্ত রাস্তা। তারপর প্রাচীন স্থাপত্য।
_এই অনিম, ওটাই কিন্তু কুকোঙ।
_কুকোঙ মানে কী?
_মানে ফরবিডেন সিটি। মানে তোমাদের নিষিদ্ধ নগরী। চলো ওই আন্ডারপাস দিয়ে ওই পারে যাই।
_চলো।
বিশাল ফটকের ওপর নিষিদ্ধ নগরীর প্রবেশ বারান্দা। সেখানে মাও সে তুংয়ের বিশালাকৃতির পোর্ট্রেট। যেখান থেকেই তাকাই একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকেন মাও সে তুং।
_জানো, অনিম। এই বারান্দায় দাঁড়িয়েই মাও সে তুং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
_বাহ!
অনিম একটু থামে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালায়। তারপর সিগারেটে লাগিয়ে কষে টান মারে। যুগ যুগ জিয়ো, কমরেড।
_অনিম।
_বলো।
_পা ব্যথা করছে। চলো, আমরা ওই পাশটায় দেয়াল ঘেঁষে পাতা বেঞ্চিতে বসি। বসবে?
_বসব।
বেঞ্চির সামনে সারি সারি ঝাউগাছ। গাছের পাশে পাশে বিশেষ পদ্ধতিতে রাতবাতির স্ট্যান্ড। ফলে বেঞ্চিতে বসলেও আলো চোখে পড়ে না। অথচ চারপাশ আলোকিত। সে আলোয় এক ধরনের নির্ভরতা যেন জড়িয়ে আছে। বেঞ্চিতে কিছুক্ষণ বসার পর ওপরে পা তুলে বসে মুনিয়া। যেন কুকোঙয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাও সে তুংয়ের স্বাধীনতা ঘোষণার স্বাধীনতা তাকে পেয়ে বসে। মুনিয়া দীর্ঘ একটা হাই তোলে।
_অনিম?
_বলো, মুনিয়া।
_তুমি বেঞ্চির শেষ মাথায় গিয়ে বসো। আমি লম্বা হয়ে শুয়ে তোমার কোলে মাথা রাখব।
_আচ্ছা, রাখো।
রাতের প্রথম প্রহর শেষ। রাস্তায় মানুষের চলাচলও কমে গেছে। আশপাশের বেঞ্চিগুলোতে আরো অনেক জোড়া জোড়া ছেলে-মেয়ে বসে কিংবা হেলান দিয়ে। রাস্তার যানগুলোতে এখন গতি দিনের চেয়ে অনেক বেশি। গতিময় চাকার শিরশির করা আওয়াজ কানে লাগে। ভাগ্যিস হর্ন বাজায় না কেউ।
_অনিম?
_বলো, মুনিয়া।
_আমার চুলে একটু বিলি কেটে দেবে? জানো, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মা আমার চুলে বিলি কেটে দিতেন।
_এই, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়তে চাও নাকি?
_ না না, তা হবে কেন! মাকে অনেক মনে পড়ছে।
_আজ ফোন করোনি?
_করেছি।
_তাহলে?
_বহুদিন দেখিনি তো।
_বাড়ি যাও।
_বললেই হলো! কাজ আছে না! আর এত টাকা এখন কোথায় পাব! নববর্ষ ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। ট্রেনে করে আমার প্রদেশে যেতে তিন দিন লাগে।
_হ্যাঁ। আগেও আমাকে বলেছ।
_এখন গেলেও মা সময় দিতে পারবেন না। প্রতিদিন তাঁরও যে চাকরি। আর বাবা তো বাড়িই ফেরেন না।
_কেন, তোমার বন্ধুরা আছে না!
_থাকলে কি হবে! তাদেরও সময় কই।
মুনিয়া অনিমের ডান হাত টেনে নেয় তার হাতের মুঠোয়। আঙুল নিয়ে খেলা করতে থাকে। মৃদু চাপ দেয়। আবার ছেড়ে দেয়। সটান শরীরটাকে আরেকটু আরাম করে অনিমের কোলে যেন লুকাতে চায়। এবার আবার হাতটাকে নিয়ে খেলা করতে করতে কপালে আর গালে ঠেকায়। অনিম বাধা দেয় না।
_আচ্ছা অনিম, তুমি চলে গেলে আমার কী হবে? তুমি কি চলেই যাবে?
_হ্যাঁ, চলেই যাব।
_আমাকে নেবে?
_সেটা বোধ হয় সম্ভব না।
মুনিয়া চিত হয়ে শোয়ার ভঙ্গি পাল্টে অনিমের কোলের দিকে মুখ ঘোরায়। সেটাও ভালো না লাগায় আবার রাস্তার দিকে মুখ করে। অনিমের হাত তার ধরাই ছিল। সেই হাতটাকে নিয়ে খেলতে খেলতে মুনিয়া অনিমের হাতটা তার বুকের ওপর রাখে। সেখানে একজোড়া কবুতরছানা। টি-শার্টের ওপর দিয়ে অনিম কবুতরছানা দুটিকে আলতো আদর করে। মুনিয়া অনিমের হাত থামিয়ে দেয়। কিন্তু ছাড়ে না। কবুতরছানা দুটির মাঝখানের শূন্যস্থানে অনিমের হাত স্থির হয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকার পর মুনিয়াই হাতটি টি-শার্টের ভেতর লুকানো কবুতরছানার কাছে নিয়ে যায়। কী অপূর্ব পালকের উত্তাপ! অনিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুনিয়া 'মাম্মি, ও মাম্মি' বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

তিন.
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে অনিমকে। সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে উঠতে না পারলে অফিসে পেঁৗছতে দেরি হয়ে যায়। আজও খেতে ইচ্ছা করছে না। এমনটা আজকাল ঘন ঘন হচ্ছে। ফ্রিজে কয়েক রকম খাবার থাকলেও সেসবে আগ্রহ বোধ করছে না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শরীরের কোথাও কি সমস্যা তৈরি হলো? রান্নাঘর থেকে প্রমাণ সাইজের একটা ইঁদুর বেরিয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে খাবার ঘরের চেয়ারের পায়ে আঘাত পেয়ে কিচকিচ শব্দ করে। ইঁদুরটারও নিজস্ব প্রাণবন্ত একটা জীবন আছে। সে জীবনে অনিম পারতপক্ষে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। ল্যাপটপে আবার চোখ বোলায়। ফেসবুকে অনলাইনে অন্তত ১০-১২ জন রয়েছে। নিউজ সাইটগুলোতে এখন প্রধান শিরোনাম_মধ্যরাতে আবার তেলের দাম বাড়ল লিটারে পাঁচ টাকা। এসবে অনিমের আগ্রহ থাকলেও করার কিছু নেই। ফেসবুকের ইনবঙ্ েশো করছে তিনটি পোস্ট। সেখানে ক্লিক করলে দেখে, তিনটি পোস্টই রিকির। ক. সিলিকন সভ্যতা ঘষে কী দারুণ ঝলমলে আছি! আমার চারপাশজুড়ে বহু বর্ণিল আলোর রেখা। একটু অন্ধকার দেবে? খ. আমি তো ডাকিনি সেই রাতগুলোকে। আমি তো আলিঙ্গন করিনি সেই রাতগুলোর প্রচ্ছায়ায়! তরঙ্গ তরঙ্গ হয়ে মুঠি মুঠি বিষণ্নতাগুলো তোমার দরজায় কড়া নাড়লে তুমি ফিরিয়ে দাও দখিন হাওয়া। তাহলে আমার কি কোথাও আশ্রয় নেই? গ. লাশকাটা ঘরে কখনো যাইনি। মৃত্যুর পর যাব একবারে। কবরে ফেরার ইচ্ছা নেই। এটা আমার নিজের জীবন। আর তুমি, মা মেরির নামে আমাদের সন্তানকে লাশকাটা ঘর হয়ে কবরে পাঠালে! এটা কী তোমার জীবন? তিনটি পোস্টে তিনটি প্রশ্ন রেখেছে রিকি। কেন? কেন অনিমকে এ ধরনের বিষণ্ন তিনটি বিষয় পোস্ট করল রিকি? কে এই রিকি? ভার্চুয়াল জগৎ থেকে সে তো কখনো বাস্তবে আসে না। সুতরাং এই তিনটি পোস্ট নিয়ে মন্তব্য করেও কোনো লাভ নেই। কারণ এরপর যে পোস্ট ইনবঙ্ েপাঠাবে রিকি, তার সঙ্গে এর কোনো মিল থাকবে না। ভার্চুয়াল জগতে এমন কিছু কি সৃষ্টি হচ্ছে, যা মানুষ নয়, খোদ ভার্চুয়াল জগৎ নিজেই তৈরি করছে?
অনিম আর ভাবতে চায় না। চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম। ঢাকনা টেনে ল্যাপটপ পাশে সরিয়ে ঘরের বাতি অফ করে। বালিশের ওম খুঁজতে খুঁজতে ঘুমের অতলে হারিয়ে গেলে প্রীতি এসে সামনে দাঁড়ায়। তুই একটা কুত্তা আর শুয়োর। তোকে নিয়ে আমার ভাবতে হবে কেন? তুই মরলে আমার কী আসে-যায়? তোকে কেউ নেবে না! আমিও না! এই প্রীতিই হঠাৎ পাল্টে গিয়ে খিলখিল হাসতে থাকে। সিল্ক-মসৃণ পোশাকে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। প্রীতির শরীর থেকে একটা একটা করে পোশাক খসে পড়ে। বোধহীন শরীরে ধীরে ধীরে বোধ ফিরে আসার মতো অনিম ঘুম রেখে চোখ মেলে। ঘর ভর্তি অন্ধকার। এই অন্ধকার অতি চেনা। প্রতিদিনের। এর রূপ-রং একটুও পাল্টায় না। এই অন্ধকার নিয়েই আরেকটি ব্যর্থ ভোরের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর ভোর শেষে ফের সেই গতানুগতিক সন্ধ্যা, যাতে লটকে থাকবে রিকি, প্রীতি কিংবা মুনিয়ার অমীমাংসিত কঙ্কাল। যে কঙ্কালগুলোয় এলোমেলো হাওয়ারাও আর সুর তোলে না।

No comments

Powered by Blogger.