পাঁচ নম্বর ঘাটে দুজন একা মানুষ by আলফ্রেড খোকন

তাব্দী থাকে ঢাকায়। একটি ভাড়া বাসার চিলেকোঠার এক রুমে। দরজা খুললেই উঠানের মতো ছাদ। রাতে বাসায় ফিরে ছাদে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়, তখন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ছোটবেলার উঠান। এই শহরে কোনো উঠান নেই। ভাবতে ভাবতে একপা-দুইপা করে বহু পুরনো পিতলের তালাটির ভেতর জিনসের কনিষ্ঠ পকেটে রাখা চাবিটি বের করে ঢুকিয়ে দেয় অন্ধকারে। অন্ধকারের ভেতরই সে তালার আধারে চাবিটি ঢোকানোর চেষ্টা করে। এবং ঢুকেও যায়।


এ থেকে শতাব্দীর মনে একটি ধারণার জন্ম হয়; মন থেকে কিছু ঢোকাতে চাইলে ঢুকবে, আবার মন থেকে কিছু বের করতে চাইলে বের হবে। যেমন তার তালা খোলার এই অধ্যায়টি। অন্ধকারে কিছুই যখন দেখা যায় না, তখনো সে নিশ্চিন্তে তালাটির ভেতর চাবি প্রবেশ করাতে পারে। আর তালাটি খুলেও যায়। তালাটি খোলার পর অবশ্য তার মনে একটি অন্য ধারণার জন্ম নেয়, তা হলো_তালাটি না খুলতেও পারত। তালার ভেতরে চাবি ভেঙে যেতে পারত। যেমন_আজ যদি জালালকে সে ওইভাবে জিজ্ঞেস না করত।
জালাল থাকে নদীতে। নদীর নাম শীতলক্ষ্যা। নারায়ণগঞ্জের পাঁচ নম্বর খেয়াঘাটের মাঝি সে। এপার-ওপার করে। জনপ্রতি ভাড়া ১০ টাকা। রিজার্ভ নিলে ৪০ টাকা। নদীর ওপারেই তার বাস। দিনে সে নদীতে। রাত নেমে এলে জনজীবনের পারাপারের সম্ভাবনা যখন একেবারে কমে যায়, তখন সে ফেরে। কিন্তু কই ফেরে, তা শতাব্দী জানে না। শতাব্দী প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে শীতলক্ষ্যার এই ঘাটে বিকেল ৫টা নাগাদ এসে পেঁৗছে। জালালও শতাব্দী সম্পর্কে জানে যে সে ঢাকা থেকে আসে। এই হচ্ছে দুজনের জানাজানির গল্প। এর মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্বই যেন ওদের উঠান। জালাল জানে, এই স্যার নদী ভালোবাসে। আর শতাব্দী জানে, এই মাঝি নৌকা চালায়। জালাল দেখে, শতাব্দী এসেই নৌকায় শুয়ে পড়ে, তারপর জালালের ইচ্ছামতো যেদিক খুশি নৌকা চলে। প্রথম প্রথম শতাব্দী এখানে এসে নৌকার খোঁজ করত। সময় ধরে দরদাম ঠিক করত। কিন্তু জালালের সঙ্গে তার প্রথম দিন নৌকাযাত্রার পর থেকে আর কোনো দরদাম এবং নৌকা খোঁজার গল্প নেই। প্রথম যেদিন সে জালালের নৌকায় চড়ে, সেদিন অবশ্য দরদাম ও সময় ঠিক করার মুহূর্তে জালাল বলেছিল, 'আপনি দিয়েন, কওয়া লাগবে না।'
এরপর নৌকা থেকে নামতে নামতে শতাব্দী তাকে বলে, 'আমি প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় এখানে আসি।' পরের বৃহস্পতিবার ঠিক বিকেল ৫টায় ঘাটে এসে শতাব্দী দেখে, জালাল অপেক্ষমাণ। অন্য মাঝিরা কেউ কেউ তাকে ডেকেছিল। কিন্তু জালালের একটুকরো চাহনি সব ডাকাডাকি ম্লান করে দেয়। শতাব্দী তার নৌকায় উঠে বসে। এর পরের সপ্তাহগুলোতে আর কোনো মাঝি তাকে ডাকেনি। এবং তার অপেক্ষা করতে হয়নি। অথচ দুজনের মধ্যে কথা হতো দুই থেকে তিনটি! কখনো জালালের কাছ থেকে 'চা?' আর শতাব্দীর কাছ থেকে 'যাই।' 'চা' আর 'যাই'_এই দুটি শব্দের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত। মাঝে শুধু বইঠার সঙ্গে জলের মিলিত শব্দগুলো। আর শীতলক্ষ্যার পাড়ে ধু ধু করা জনজীবনের বিলীয়মান শব্দরা। সেই শব্দে যাদের দরকার আছে, তারাই শুধু অর্থ উদ্ধার করত। এর বাইরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো যখন ঘাটে ভিড়ত, তখন লঞ্চের সাইরেন সব শব্দকে ছাপিয়ে যেত। এসব শব্দে অবশ্য শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীর ঘেঁষে প্রাচীন রেইনট্রির ছায়াঘেরা নদীর কিনারায় যৌবনমদে মত্ত তরুণ-তরুণীরা উপকৃত হয়ে থাকবে। কারণ নদীর ওই দিকটায় ছেলেমেয়েদের প্রেমপর্ব চলে। একটু লুকিয়ে, স্থলভাগের জটিল-কুটিল চক্ষু এড়িয়ে এই জলে ওদের কামোদ্দীপক দেহের চুম্বনতৃষ্ণার কিছুটা হলেও মেটে। পঙ্ক্তির ভেতর একটা শব্দ থেকে আরেকটা শব্দের যেমন দূরত্ব থাকে, তেমনি দূরত্বে থাকে নৌকার ভেতরের মানুষদ্বয়। আর তীর ঘেঁষে পঙ্ক্তির ভেতর শব্দ থেকে শব্দের মতো দূরত্বে থাকে নৌকাগুলো। খুব ধীর এই নৌকাগুলোর গতি। মাঝিকে কিছুই বলে দিতে হয় না। মাঝিরা এমনিতেই বুঝে নেয়। মাঝেমধ্যে টহলদার জলজ পুলিশের স্পিডবোট যখন পাহারার নামে নায়কের মতো চলে যায়, তার ঢেউগুলো প্রেমিক-নৌকাগুলোকে ঢেউয়ের দোলায় মুহূর্তের জন্য টালমাটাল করে দেয়। এতে অবশ্য প্রেমিক জুটিদের কোনো উপকার হয় কি না তা বলা আমার পক্ষে মুশকিল। আবার কোনো কোনো হতচ্ছাড়া তরুণ এসব চুম্বনদৃশ্য, গা ঘেঁষে থাকা দুটি তরুণ-তরুণীর অভ্যন্তরীণ হাহাকারের দৃশ্য উপভোগ করতেও মাঝেমধ্যে নৌকা ভাড়া করে আসে। তাকায়, লোলুপ জিহ্বায় নিঃসৃত লালা নিয়ে ঢোঁক গিলে খায়, পয়সা খরচ করে।
উত্তরে একটু এগিয়ে গেলে জেটি। জেটির নিচেও নৌকার ভিড় থাকে। সেখানে আরো একটু বেশি গোপনীয়তা, একটু নীরবতার বিরল ব্যাপার বলে মনে হয়।
কিন্তু জালাল আর শতাব্দীর মধ্যে যে নৈঃশব্দ্য, তাতে গোপনীয়তার কোনো মানে বয়ে নিয়ে আনে কি না, তা কে বলবে?
জালালের মনে মাঝে মাঝে বিস্ময় জাগে, এই লোকটি, অর্থাৎ জালাল যাকে স্যার সম্বোধন করে, সেই লোকটি একা একা এখানে আসে। তার কোনো উদ্দেশ্যই জালাল আন্দাজ করতে পারে না বলে মনে হয়। এসেই সে শুয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে উঠে বসে কী যেন লেখে। এটুকু বিস্ময় ছাড়া আর কোনো বিস্ময়ের সুযোগ নেই শতাব্দীকে দেখে। কোনো প্রশ্ন নেই, অভিযোগ নেই_এ কেমন মানুষ! বুধবারের কথা মনে পড়ে তার। খেয়া পারাপারে কত যাত্রীর সঙ্গে জালালের দেখা হয়। কত রকম আচরণ তাকে সহজে মেনে নিতে হয়। মাত্র এপার থেকে ওপারে যেতে মানুষগুলোর কত রকম আচরণ জালাল দেখে তার কোনো শেষ আছে। ভাড়া কম দেওয়ার চেষ্টা, আগে ওঠার প্রচেষ্টা। প্রত্যেকে সবাইকে টপকে আগে নামার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আবার নদীর মধ্যেই কতজন গালাগালি দিয়ে কতজনকে নির্বংশ করে দিচ্ছে! অথচ এই লোকটার কোনো অনুযোগ নেই। এভাবে জালাল আর শতাব্দীর প্রতিটি বৃহস্পতিবার কাটে।
কিছুদিন পর জালাল বৃহস্পতিবার অন্য কোনো ভাড়া নেওয়া বন্ধ করে দিল। বিকেল ৩টার দিকে এপারে নৌকা ভিড়িয়ে সে বসে থাকে। একটা ফ্লাস্ক কিনছে সে। তাতে লিকার চা ভর্তি করে রাখে। সঙ্গে গৃহস্থের হাতের তৈরি মুড়ি। ঘাটপাড়ের ধনেকারের দোকান থেকে শিমুল তুলা দিয়ে বানানো একটা বালিশ কেনে সে। এভাবে তার বৃহস্পতিবারের দিনযাপন শুরু হয়। এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষাও শুরু হতে থাকে।
আজ বৃহস্পতিবার শতাব্দীর দেরিতে ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে যায়। গ্যাসের চুলার ওপর ছোট্ট পাতিলে রাখা মিল্ক ভিটা দুধ। সরা দিয়ে না ঢাকার ফলে একটি তেলাপোকা আপনমনে ডুবে ডুবে দুধ খেয়ে এখন দুধেই হাবুডুবু খাচ্ছে। আর দুই টাকা দামের বনরুটির টুকরোটির পোড়া অংশটি শুধু তাকিয়ে আছে শতাব্দীর দিকে। ইঁদুর তা মনের সুখে খেয়ে গেছে। পর্যাপ্ত খাবারের জন্য ইঁদুর পোড়া অংশ খেয়ে উঠতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে শতাব্দীর নাশতা খাওয়া হয় না। সে গোসলখানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু যৌথ গোসলখানায় তখন তরুণী কণ্ঠের গান ভেসে আসে। এই কণ্ঠ শম্পার। শতাব্দী কুমার ভাড়াটে। শম্পা আর মনিরের যৌথ সংসারে সে সাবলেট। দুই রুম। কিন্তু গোসলখানা একটি। ফলে তার অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু এমন অপেক্ষার সময়কে কোনো গালমন্দ করা যায় না। কারণ মানবজীবনে পুরুষের এমন একটি বয়স থাকে, যখন যেকোনো নারীর স্বর অপেক্ষমাণ সম্ভাবনাকে আরো ভরিয়ে তোলে। তখন বেসুরো গলার গানও মন্দ লাগে না। শম্পা শতাব্দীকে মামা ডাকে। মামা সম্বোধন এখন সর্বসাধারণ হয়ে গেছে। সম্পর্কহীন কোনো সম্বোধনের ডাকনাম এখন মামা। শতাব্দীকে কাল যখন চায়ের দোকানদার মামা বলে ডাক পারল, তখন তার হাসি পেয়েছিল। কিন্তু শম্পা যখন মামা ডাকে, তখন তার কিছু বলার থাকে না। মামা একটি নিরাপদ সম্বোধনের নাম।
নারায়ণগঞ্জ, শীতলক্ষ্যা নদী। তার আগে চাষাঢ়া মোড়। মোড়ের মধ্যে শতাব্দীর অনেক গল্প। অনেক দৃশ্য, অনেক লুকানো হাসি। গানের সুর। চায়ের গন্ধ। সিনেমা পোস্টার। বোস কেবিন। মাসির হোটেল। লাশকাটা ঘর। রেললাইন। আবার সব ছাপিয়ে একটা কৃষ্ণচূড়াগাছের লাল। মনে হয় রাস্তাজুড়ে আগুন লেগেছে। একটার পর একটা দৃশ্য স্লাইড শোর মতো চলে আসছে। সব দৃশ্য, সব সুর, সব ছাপিয়ে কয়েকটি মুখ ভাসে। কয়েকটি মুখ থেকে একটি মুখ যখন মনে আসে, তখন জালালের কথা মনে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি সে উঠে বসে। দুপুরের খাওয়ার পরপরই বেরোতে হবে তার।
জালাল ভাবে, স্যার কি কোনো শিল্পী? লোকটিকে তার চেনা হলো না একটুও। অথচ প্রায় এক বছর ধরে সে পাঁচ নম্বর ঘাটে আসে, তার নৌকায় চড়ে। কিছু বলে না। তবে কি লোকটা ভীষণ দুঃখী। এখনো সে বিয়েও করেনি, করলে অন্তত একদিন না একদিন তাকে দেখা যেত। বিয়ের বয়স অবশ্য পার হয়নি। নাকি কোনো গোয়েন্দা! অবশ্য এই নদীতে তার গোয়েন্দাগিরির কোনো মানে হয় না। সে তো এসে কেবল শুয়ে থাকে। বললে চা খায়। নিজে কিছুই বলে না। মেঘ হলে আকাশের দিকে তাকায়। বৃষ্টি এলে উঠে বসে গুলুইয়ের দিকে এগিয়ে যায়। আর তখন একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটের আগুনটা অবশ্য তার কাছ থেকেই নেয় সে। কী করে, কোথায় থাকে, কিছুই জানে না জালাল মাঝি। শুধু তার পরিচয়, সে ঢাকা থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় এই পাঁচ নম্বর খেয়াঘাটে আসে। জালালের নৌকায় কয়েক ঘণ্টা বসে থাকে, রাত ১০টার দিকে নেমে চলে যায়। ভাড়া নিয়ে কোনো দিন তাকে কিছু বলেনি। পকেট থেকে যা বের হয়, মুঠো ভরে দেয়। গুনেও দেখে না। একদিন তো ৫০০ টাকার নোট দিল। সে বলতে নিল, 'স্যার...', শতাব্দী থামিয়ে দিয়ে হাত নেড়ে কী যেন বলল। একবারও পেছনে তাকাল না। আরেক দিন আবার কম দিল। মনে আছে সেদিন বলেছিল, 'আজ আমার হাত খালি।' তার যে বয়স, সে বয়সে তো মুনি-ঋষি হয় না। তবে স্যার কে? মাঝে মাঝে জালালের মনে এই প্রশ্ন জাগে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো বাড়াবাড়ি নেই। জগতে তো কত কিছু দেখেই প্রশ্ন জাগে, প্রশ্নহীন উত্তর মিলিয়ে যায়। নদীর মধ্যেই যেমন কত কথা, কত প্রশ্ন ঢেউয়ের মতো আসে, মিলিয়ে যায়। আকাশে মেঘ ওঠে। ঝড় আসে আবার সে ঝড় থামে। আবার সব যেন আগের মতোই চলতে থাকে। কত যাত্রী আসে, কত যাত্রী নেমে যায়_কোনো দিন কোনো প্রশ্ন মনে আসে, কিন্তু করা হয় না। জালালের কাছে উত্তরগুলোও যেন প্রশ্নের মতো। প্রশ্নের যেমন শেষ নেই, উত্তরেরও অন্ত নেই।
আজ মনে হয় মেঘ হবে। এমনিতেই জ্যৈষ্ঠ যায় যায় করছে। আষাঢ় শুরু হতে আর কয় দিন বাকি। এবার তেমন ঝড়ঝাপটা পোহাতে হয়নি।
এমন সময় শতাব্দী এল। আজ তাকে একটু এলোমেলো মনে হয়। হাতে তার সিগারেট নিভছে না। কয়েকটা চুল চশমার ফাঁকে আটকা পড়ে আছে। জামার একটা বোতাম আরেকটা ঘাটে লাগানো, সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। এভাবেই সে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে এসেছে! শতাব্দী উঠেই সরাসরি নৌকায় শুয়ে পড়ল। সে বলল, 'আজ নৌকা একটু মাঝখানে নাও। বেশ গরম লাগছে।' জালাল বৈঠা মারতে শুরু করল। নদী আজ একটু উচ্ছল। এমন সময় শতাব্দী জালালকে বলল, 'জালাল, তুমি গান জানো?' জালালের উত্তর, 'না, স্যার। আমি মূর্খ মানুষ।' শতাব্দী বলল, 'জ্ঞানীরা গান গাইতে পারে, এটা তোমাকে কে বলেছে। গান গাইতে জ্ঞানী হতে হয় না। তুমি গান ধরো। আমার মনে হয় তুমি গান জানো।' জালাল আর কথা না বাড়িয়ে গান ধরল। বৈঠার তালে তালে গান গাইতে থাকল :
মাঝ নদীতে বৃষ্টি আসে আমার করে ভয়
সে কি মেঘের কিছু হয়!
ঘাটে ঘাটে নাও বান্ধিলাম কিনারে কিনারে
আমারে বান্ধি নাই আমি এ ভবসংসারে
আমারে বান্ধি নাই আমি তবু সে ডাকিল স্বামী
সুজন-কুজন নামিদামি কত কথা কয়
সে কি মেঘের কিছু হয়!
গান শেষ হতে শতাব্দী বলল, 'জালাল, গানখানা কার?' জালাল বলল, 'আপনার।'
'তুমি জানলে কী করে?'
'গত বৃহস্পতিবার যখন অল্প তুফান হইছিল, তখন আপনি এই গানখান লিখছিলেন মনে হয়। নৌকার ছইয়ের ভেতর কাগজের টুকরা গাঁথা ছিল। আমি অল্প পড়া জানি। এই দেখেন আপনার লেখা!
এর মধ্যে শীতলক্ষ্যার ঠিক মাঝনদীর ওপরে একখণ্ড ঘন কালো মেঘ এসে দাঁড়ায়। চারদিক আঁধার করে আসছে। নদীর পানি কালো রং ধারণ করছে। মুহূর্তে চারপাশের সব কিছু যেন বদলে গেল। ঝড়ে হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। শতাব্দীকে এই প্রথম বিচলিত হতে দেখল জালাল। শতাব্দী বলল, 'তুমি নৌকা তীরে নাও, আমার ভয় করছে।' জালাল বলল, 'স্যার, ভয় নাই, ঠিক হয়ে যাবে।' এই বলে সে নৌকা নিরাপদে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকল। নদী ফুলছে। নৌকা দুলছে। বৃষ্টিসহ ঝোড়ো বাতাস পর পর ধাক্কা দিচ্ছে। জেটিতে নোঙর করা ছোট ছোট জাহাজ একটা আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা লেগে, টান লেগে কড়মড় করছে।
ইতিমধ্যে জালাল নৌকা জেটির নিচে নিয়ে ভিড়িয়েছে। শতাব্দী জালালকে বলল, 'আচ্ছা জালাল, তুমি তো মাঝি নও, তবে কেন নৌকা বাও?' স্যারের কণ্ঠে এই কথা শুনে জালাল হতবাক। শতাব্দী আবার পুনরাবৃত্তি করল, 'কী, বলছ না কেন তুমি নৌকা বাও?'
দ্বিতীয়বার এ কথা শুনতেই জালালের দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল। সেই জল নদীর জলের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা মিশে গেল কি না, সে দৃশ্য দেখার সুযোগ শতাব্দীর আসেনি। কিন্তু সে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবে, তাই জালালকে আবার বলল, 'তুমি কাঁদছ কেন, আমি তো ভয়ে পড়ে তোমাকে বলেছি। তবে হ্যাঁ, তোমার নৌকা চালানোয় তেমন দক্ষতা নেই। এর আগে তুমি নিশ্চয় অন্য কাজ করতে?' জালাল বলল, 'স্যার, আপনি ঠিক বলেছেন।'
শতাব্দীর কৌতূহল বাড়ল, 'কী ঠিক বলেছি?'
'স্যার আমি অল্প কয়েক বছর হলো এই নদীতে খেয়া বাই।'
'কেন বলো তো?'
জালাল আর কথা বলছে না। তার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। বৈঠা মারার ফাঁকে অথই যে জল নদীর, সেই জলের ভেতর জালারের দুই ফোঁটা অশ্রু লুকানো ততটা সহজ হলো না। সে চোখের জল লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টাই করল বলা যায়। কারণ কান্নার সঙ্গে সঙ্গে কান্নার স্বর জড়িয়ে থাকে বলে কোনো কোনো কান্না লুকানো যায় না।
শতাব্দী প্রথমে ভেবেছিল, জালালের অদক্ষতা ধরে ফেলার কারণে শতাব্দীকে হারানোর সম্ভাব্য আশঙ্কায় সে তার বেদনা লুকাচ্ছে কি না। তাই এ চোখের জল।
শতাব্দী আবার জানতে চাইল, 'কেন তুমি এই নদীতে?' অনেক পীড়াপীড়ির পর জালাল বলল, 'স্যার, আপনি আসেন নদীতে চলতে। আর আমি আইছিলাম পার হইতে। সেবার নদী পার হওয়ার সময় এই নদীতে আমার ছোট মেয়েটা পড়ে যায়, আমার হাত ধরে লক্ষ্মী মা আমার বসেছিল।' এ কথা বলতেই জালাল হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বৈকালিক কুয়াশাজনিত আচ্ছন্ন শীতলক্ষ্যার দুই পারে জনজীবনের কত রকম গল্প-কাহিনী রচিত হচ্ছে প্রতিদিন! কত কাহিনী জন্ম নিচ্ছে, কত কাহিনীর মৃত্যু হচ্ছে! নদীর মধ্যে বসে তার কতটুকুই সে অনুভব করতে পারবে।
এক হাতে বৈঠা, এক হাতে গলার গামছার কোনা। গামছার কোনায় চোখের নিঃসঙ্গ জল মুছতে মুছতে সে বলল, 'স্যার, সেই থিকাই আমার ঠিকানা পাঁচ নম্বর খেয়াঘাট। আপনি আসলে পারাপার বন্ধ। আপনি চলে গেলে পারাপার শুরু।'
শতাব্দী ভাবল, পাঁচ নম্বর খেয়াঘাট থেকে চিলেকোঠার দূরত্ব কত? দূরত্ব যা-ই হোক, তারা দুজনই কী যেন খুঁজে ফিরছে। জালাল খুঁজছে জলের ভিতর আর শতাব্দী জলের বাহির।
যে আকাশ এতক্ষণ কালো হয়ে ঝড়ঝঞ্ঝায় ক্ষুব্ধ ছিল, শীতলক্ষ্যার পাড়ে দাঁড়ালে সে এখন অবোধ শিশুর মতো তাকিয়ে আছে।

No comments

Powered by Blogger.