প্রাকৃতিক রং ‘রংধনু’ by মোকারম হোসেন

ত বছর প্রথম আলোয় রঞ্জক উদ্ভিদ দইগোটার ফুল নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখার কিছুদিন পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হরিপদ শীল আমাকে ফোন করে তাঁর একটি প্রাসঙ্গিক গবেষণার কথা জানান। ওই প্রতিবেদনে কৃত্রিম রঙের পরিবর্তে প্রাকৃতিক রং ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছিলাম।


অধ্যাপক হরিপদ শীল খাবারে ব্যবহারের জন্য তাঁর নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি প্রাকৃতিক রং ‘রংধনু’র কথা বলেছিলেন। তিনি মূলত আমাদের প্রাকৃতিক রঙের অন্যতম উৎস দইগোটার ওপর প্রায় পাঁচ বছর গবেষণা করে রংটি যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য চারটি ফর্মুলা তৈরি করেছেন।
প্রাচীনকাল থেকেই রঞ্জক হিসেবে দইগোটা বিক্ষিপ্তভাবে ব্যবহূত হচ্ছে আমাদের দেশে। তবে জানামতে, এ ক্ষেত্রে মানুষ শুধু সাধারণ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে। কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্র বা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি। কিন্তু হরিপদ শীল আমাদের জন্য বৈজ্ঞানিক নিয়মনীতি মেনেই উদ্ভাবন করেছেন এই রং ব্যবহারের যথাযথ উপায়।
রংধনু রং উৎপাদিত হয়েছে দইগোটা বা লটকন ফল (Bixa orellana) থেকে। তবে এটি জনপ্রিয় খাদ্যোপযোগী ফল লটকন নয়। এর প্রচলিত ইংরেজি নাম ‘লিপস্টিক ট্রি’।
বর্তমানে প্রায় সব ধরনের খাবারে রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হয়। এর অনেকগুলোই স্বাস্থ্যের জন্য কমবেশি ক্ষতিকর। এর স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প হতে পারে প্রাকৃতিক রং। তবে তা দেশে সহজলভ্য নয়। সে ক্ষেত্রে দেশীয় গবেষকের উদ্ভাবিত রং রংধনু কিছুটা হলেও এ অভাব দূর করতে পারবে।
সম্প্রতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম এ নিয়ে গবেষণা সম্পর্কে বিশদ জানতে। কাজটির সূত্রপাত সম্পর্কে বলতে গিয়ে হরিপদ শীল জানান, ২০০৫ সালে ক্রপ বোটানি বিভাগের অধ্যাপক সোলায়মান আলী ফকিরের অধীনে একজন ছাত্রী প্রথম এ বিষয়ে এমএস করার জন্য ভর্তি হন। হরিপদ শীল ছিলেন ওই শিক্ষার্থীর পরিদর্শক। মূলত, তখন থেকেই দইগোটা বা লটকন নিয়ে তাঁর ভাবনা শুরু।
হরিপদ শীল দইগোটা-গাছের তিন প্রজাতির ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট মানের রঞ্জক পাওয়া যায় এমন একটি প্রজাতি (খয়েরি রঙের ফল) বাছাই করেন রং তৈরির জন্য। নাম রাখেন M3. এই প্রজাতি এ দেশে সহজলভ্য।
প্রথমেই পরিপক্ব ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। তারপর নিষ্কাশন, আঠা ও মোম দূরীকরণ, বাষ্পীপাতন, মিহিকরণসহ আরও কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয় রংধনু ১, ২, ৩ ও ৪ নামের রংগুলো। রংধনু-১ মূলত স্বচ্ছ পানির দ্রবণ। অর্থাৎ, এই রং প্রয়োজনমতো যেকোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্যে পানির সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে। তবে টকজাতীয় পানির সঙ্গে মেশানো যাবে না। রংধনু-২ পাউডার ধরনের। এটিও পানিতে মিশিয়ে খাদ্যদ্রব্যে প্রয়োগ করা যায়। রংধনু-১ কমলা হলুদ, রংধনু-২ গাঢ় লাল রঙের। রংধনু-৩ পাউডার ধরনের। এটি কেবল তেল, ঘি, মাখন ইত্যাদি ভোজ্যতেল ও তেলজাতীয় পদার্থের জন্য। রংধনু-৪ প্রক্রিয়া করা রঙের বীজ। এই মাধ্যমে বীজটি এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে, যা ঠান্ডা বা গরম পানিতে দুই মিনিট ভিজিয়ে রেখে নাড়লেই পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় রং।
হরিপদ শীল জানিয়েছেন, প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ কোনো উপাদান প্রয়োগ করা হয়নি। পুরোটাই প্রাকৃতিক। রংধনুর পাউডার দেড় বছরের বেশি সময় এবং তরল রং এক বছর ব্যবহারের উপযোগী থাকবে। দুই বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কেক, পুডিং ও জর্দা তৈরি করতে এই রং ব্যবহূত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাবুর্চি আবদুল ও আনোয়ার।
এর সুবিধার বিষয় হচ্ছে, দেশের সর্বত্রই দইগোটা খুব সহজে চাষযোগ্য। কোনো বাড়তি পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। এই রং তৈরির ব্যয়ও কম।
সবশেষে, এই বিশেষ রঞ্জক গাছটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানা যাক।
অনেকেই এ গাছকে জাফরান বলে ভুল করেন। আদতে জাফরান নামীদামি সুগন্ধি। এর গাছ বর্ষজীবী ও পিঁয়াজকন্দীয়। জন্মে শীতের দেশে। জানামতে, আমাদের দেশে জাফরানের চাষ হয় না।
দইগোটা ক্রান্তীয় আমেরিকার প্রজাতি। ১৭০০ শতাব্দীর দিকে স্পেনীয়দের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি ছড়িয়ে পড়ে। দইগোটা-গাছ ছোট, ঝোপালো, চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচু ও চিরসবুজ। পাতা বড়, ১০ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার লম্বা। প্রস্ফুটনকাল শরৎ থেকে শীতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত। একসঙ্গে অল্প কয়েকটি ফুল ফোটে। দেখতে গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি বা সাদাটে। পাঁপড়ির মাঝখানে হলুদ-সোনালি রঙের এক গুচ্ছ পুংকেশর থাকে। ফল তিন থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার চওড়া, লালচে বাদামি বা খয়েরি রঙের নরম কাঁটায় ভরা। বীজ তিন সেন্টিমিটার চওড়া, লাল বা খয়েরি শাঁসে জড়ানো। এ বীজ থেকেই পাওয়া যায় প্রাকৃতিক রং।

No comments

Powered by Blogger.