মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৩৪ অভিযোগ

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফরিদপুরের তিনটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামকে তিন দিক থেকে ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনারা প্রায় ৩৫০টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করা হয় ৫০-৬০ জন নারী-পুরুষকে। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের উপস্থিতিতে ও প্ররোচনায় ওই ঘটনা ঘটে।


মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ৩৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ-সংবলিত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপক্ষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পুনর্দাখিল করেছে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগেই মুজাহিদকে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পুনর্দাখিলের বিষয়টি ট্রাইব্যুনালকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোখলেসুর রহমান। ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে আদেশের জন্য ২৬ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত পরে সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তরে মুজাহিদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একাত্তরের অক্টোবর থেকে তিনি ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানার মাঝিডাঙ্গা, বৈদ্যডাঙ্গা ও ডাঙ্গি গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেন। এ ছাড়া তাঁর নির্দেশে ও প্ররোচনায় জুনের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট গ্রামের রঞ্জিত নাথকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। ফরিদপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে অনেক মানুষকে অপহরণ করে আটকে রাখা হতো। মুজাহিদ সেখানে যাওয়ার পর তাঁদের নির্যাতন করা হতো। ফরিদপুরের ছাত্রলীগের নেতা হাবিবুল হককে অপহরণের ক্ষেত্রে মুজাহিদ ও অন্য রাজাকাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর মুজাহিদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা হিসেবে কাজ করেন। ইত্তেফাক পত্রিকার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দীন হোসেনকে ১০ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার চামেলীবাগের বাড়ি থেকে আলবদর বাহিনী অপহরণ করে হত্যা করে। এ ছাড়া শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, বদিউল আলম, জুয়েল, আজাদ, জহিরউদ্দিন জালাল, সুরকার আলতাফ মাহমুদ—এঁদের অপহরণ ও হত্যা করার ক্ষেত্রে আলবদরের প্রধান হিসেবে মুজাহিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা জানান, একাত্তরের অক্টোবরের পর আলবদরের প্রধান হিসেবে মুজাহিদ বিভিন্ন জেলা সফর করেন। পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হিসেবে রাজাকার বাহিনী, আলবদর, আলশামস গঠনের সঙ্গে মুজাহিদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ঢাকার মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। সেখানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। মুজাহিদ, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ওই ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়মিত পরামর্শ দিতে যেতেন। পরে সেখানে একই সঙ্গে রাজাকার ও আলবদরের ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ এর আগে ১১ ডিসেম্বর মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছিল। ২৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল ওই অভিযোগ সুবিন্যস্ত করে ১৬ জানুয়ারির (গতকাল) মধ্যে পুনর্দাখিলের জন্য আদেশ দেন।
আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১৫ মার্চ দাখিলের দিন ধার্য: রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী গতকাল ট্রাইব্যুনালকে বলেন, বিএনপির নেতা আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য কিছু সময় দরকার।
ট্রাইব্যুনাল আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের দিন ধার্য করেন। ওই দিন পর্যন্ত তাঁর জামিন বহাল রাখা হয়। হাজিরার দিন থাকায় আলীম ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন। গত বছরের ২৭ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ট্রাইব্যুনাল তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেন।
কামারুজ্জামানের অভিযোগের বিষয়ে আদেশ ১৮ জানুয়ারি: ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শাহিনুর ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে আদেশের জন্য ট্রাইব্যুনাল ১৮ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষ রোববার কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুনর্দাখিল করে। ১১ ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে প্রথমবার অভিযোগ দাখিল করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তা সুবিন্যস্ত করে পুনর্দাখিলের আদেশ দেন।
কাদের মোল্লার আবেদনের বিষয়ে আদেশ ২২ জানুয়ারি: জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ে আসামিপক্ষের আবেদনের ওপর আদেশের জন্য ২২ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল এই আবেদনের ওপর শুনানি করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম ও মিজানুল ইসলাম এবং রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী ও মোহাম্মদ আলী।

No comments

Powered by Blogger.