সহজ-সরল-স্বপ্ন নামের একটা বাড়ি by কনকচাঁপা

কজন কণ্ঠশিল্পী (বা হতে চাওয়া শিল্পী) হিসেবে রোজই কিছু মানুষের সঙ্গে আমার নানাভাবে, নানা কারণে দেখা হতে থাকে। গানের সুবাদে বা সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য দেখা হওয়া সেই মানুষগুলোকে আমি নানাভাবে ও সূক্ষ্ম পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। তো একদিন এক প্রকৌশলী (স্থাপত্যবিদ্যা) ছাত্রী ফোন দিল, আমার সঙ্গে তার কথা আছে।


কী কথা আমার সঙ্গে? ইট-কাঠের ঘরে সুরের প্রভাব জানতে? শব্দের, সুরের, রঙের, আলোর ওয়েভ লেন্থ জানতে? ওরে বাপ রে, আমি যে ওসব ঠিকঠাক জানি না! নাকি আমার গানগুলো আরসিসি বাড়িগুলোয় সিমেন্ট জমতে দিচ্ছে না? হা হা হা। আমার যে মাথা, তার আবার যে কথা! তার কি কোনো গাছ পাথর আছে? যাক, যে এলো তার নাম 'আশা'। বৈঠকখানায় বসেছে। সামনে গিয়ে আশা ভঙ্গ হলো। এটুকু মেয়ে? স্থাপত্য বিদ্যা? ও যে ডিম কলা খেয়ে ওর নিজের ভিতটাই গড়েনি! বাকি জীবনের গাঁথুনি-কলাম-ড্রেনেজ? হা হা হা। কুশলাদি বিনিময়ের পর জানালো, সেলিব্রিটি কারো স্বপ্নের বাড়ির মডেল ওকে বানাতে হবে, তাতে ওর ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর বাড়বে। ভালো কথা, কিন্তু আমার যে বাড়ির স্বপ্ন আছে কী নেই, তা আগে শুনবে না? সঙ্গে ওর ভাই এসেছে। যত উচ্চ শিক্ষাই নিতে থাকুক, সঙ্গত কারণেই অভিভাবক ছাড়া মানুষ নারীরা কোথাও যায় না, তাই এই ছোট ভাই। হাসি পাচ্ছে। ওর বয়সই কত, তার ছোট ভাই, তার বয়সই কত। ওরা কিন্তু সিরিয়াস। আমি কেন যেন সিরিয়াস হতে পারছি না। স্বপ্নময় চোখ জ্বলজ্বল করছে ওদের দুজনেরই। আমার স্বপ্নের বাড়ি? বাড়ি নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি না। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত মানুষের মাথা গোঁজার মতো একটু চালই 'স্বপ্ন'। সেটা বাস্তবায়িত না হলে জীবনটাই দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়। মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই থাকার পরও বাড়িওয়ালার যন্ত্রণায় তা আবার বদলাতে বদলাতে জীবন বিপন্ন হতে থাকে। আর প্রাসাদোপম বাড়ি? এ জীবনে পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই সে রকম বাড়ি দুই চোখ ভরে দেখেছি। আরে, আমাদের এই দরিদ্র দেশেই তো দেখেছি এমন বাড়ি, যার মাটির নিচেই শ্বেতপাথরে তৈরি পাঁচতারা হোটেলের সমমানের দুই তলা। যার বাগানেও শ্বেতপাথর ও গ্রানাইটের নগি্নকা কলস ওপরে পানি ঢালছে অনবরত। সেই বাড়ির মালিকই আবার তার কারখানার কর্মচারীদের দু-তিন হাজারের বেশি টাকা বেতন দিতে অপারগ! যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস বা যুক্তরাজ্যের বাকিংহাম প্যালেস থেকে আমাদের প্রেসিডেন্ট ভবন_সবই দেখেছি। কখনো মনে হয়নি এগুলো আমার স্বপ্নের বাড়ি। আশা (হবু স্থপতি) অস্থির হতে থাকে। আমি বলতে থাকি, শোন, আমার স্বপ্নের বাড়ি হবে ওই যে যমুনা ব্রিজের মধ্য দক্ষিণে যে চর পড়েছে, কিছু গাছও হয়েছে, সেখানটায়। কাশের বেড়া-ছনের চাল, কিছু গরু-ছাগল, সানকি, কয়টা হাঁড়ি! আশা এবার ঘামতে থাকে, ওর প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে! ওর চেয়ে চালাক ওর ভাই। দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ। দুই ভাইবোনেরই অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আমি আবারও বলি_শোন, আমার এটাই স্বপ্নবাড়ি। একটা ফ্ল্যাট সাজিয়েছিলাম অনেক শখে। তার ছাদে বাগান ছিল। কলার ঝাড় ছিল, সেখানে পাখি আসত! কারা যে সন্ধি করে তা ভেঙে দিল, আমি অসহায় চোখে চেয়ে থাকলাম এবং সেই বাড়ি বা ফ্ল্যাট ত্যাগ করলাম। আমি আর অমন ইট কাঠের বাড়ি বানাব না। আশা এবার শেষ চেষ্টা করে, ম্যাডাম বাড়ি না বানান, কেমন বাড়ি আপনার ভালো লাগে শুধু সেটুকু জানালেই হবে। এই বলে ওরা আমাকে শুরু করালো। ধীরে ধীরে স্বপ্ন জেগে উঠল। বিশাল ভূখণ্ড, তাতে শিমুল, জারুল, কৃষ্ণচূড়া আগুন ধরাবে, দক্ষিণা বায়ে নিম দুলবে, ফরমালিন ছাড়া ফল খাওয়ার লোভ জাগল, ফলের বাগানও তাতে জায়গা করে নিল। দক্ষিণের জানালা, প্রশস্ত শোয়ার ঘর, পড়ালেখার ঘর, প্রার্থনার ঘর, গানের ঘর, সুন্দর প্রযুক্তির আলোছায়ার খেলা করার সুযোগ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের ছোট্ট আবাসন, এমনকি ধানক্ষেতে মাছ চাষের আশাজাগানিয়া স্বপ্নও উথ্লে উঠল! আশার ভাই খুব দুষ্টু বোধ হয়। সে বলল, এই তো ম্যাডাম পথে এসেছেন! রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলি। তো ওদের বলি, তোমরা ভীষণ নাছোড়বান্দা, তাই এমন স্বপ্নের কথা বললাম, ধরো যে এটা বানিয়ে বানিয়েই বললাম। এই পৃথিবীতে কোনো বাড়ির স্বপ্ন আমি দেখি না। তবে নদীর মাঝের চরের বুকে স্বপ্নবাড়িতে ঝড়ের মুখে, জ্বালিয়ে রাখা প্রদ্বীপের আলোয়, স্বপ্নপুরুষের পাতে আরও এক হাতা ভাত বেড়ে দিতে খুব শখ হয়। কিন্তু আমার কর্তা বলেন, তোমার ওই স্বপ্নপুরুষ? পয়সা দিলেও আমি হবো না, মানে নদীর চরে বাড়ি করলে তিনি আমার সঙ্গে যাবেন না। আশা উঠে পড়ে, তার কাজ সে বুঝে নিয়েছে। এবার আমি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াই। কোথায় আমার স্বপ্নবাড়ি? মনের গহিনে একটা দুঃখ বিলাসের বেড়ায় বাঁধা 'দুঃখবাড়ি' আছে আমার; কিন্তু বাস্তবে? না, এই বাস্তব জীবনের (কোনটা যে বাস্তব জীবন তা কি আইনস্টাইনও জানেন?) শেষে দরজা-জানালা ছাড়া বাঙ্ বাড়িটাই আমার স্বপ্নবাড়ি। ওরকম একটি বাড়িতে আমার বাবা আছেন, আমি তাঁর প্রতিবেশী হতে চাই।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.