প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘট-শিক্ষা কার্যক্রম সর্বাগ্রে

দেশের কমবেশি ২৪ হাজার নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় এক লাখ শিক্ষক যে দাবিতে রোববার থেকে ধর্মঘট ও কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন, তার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ সামান্যই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষাক্ষেত্রে গত দুই দশকে নানা উন্নয়ন সাধিত হলেও সারাদেশের বিপুলসংখ্যক নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি।


এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বিভিন্ন সময়ে বাড়লেও দুর্মূল্যের বাজারে তা স্বভাবতই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তারা নানা উপায়ে দাবি-দাওয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, লাগাতার শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করে দাবি আদায়ের কৌশল কতটা ন্যায্য। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সরকার ও শিক্ষকদের মধ্যকার দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলে জিম্মি হয়ে পড়ে কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎই। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, এমন কর্মসূচি মেরুদণ্ডে আঘাতের মতোই আত্মঘাতী। দাবি আদায়ে কর্মসূচির জন্য বছরের প্রথম মাসকে বেছে নেওয়া হলো কোন বিবেচনায়, সে প্রশ্নও উঠবে। মাত্র কয়েক দিন আগে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে 'বই উৎসব' পালিত হয়েছে। ঝকঝকে বই হাতে খুশিতে ঝলমল শিক্ষার্থীর ছবি দেখা গেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। আবার কয়েক দিনের ব্যবধানে তালাবদ্ধ শ্রেণীকক্ষের সামনে সেই ছাত্রছাত্রীদের ম্লান মুখ আমাদের আশাহতই করে। প্রাথমিক শিক্ষার গোড়ার দিকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় গমন নিয়মিত ও আনন্দদায়ক করে তোলা। ভর্তির পরপরই তাদের উৎসাহ যদি বিদ্যালয়ের বন্ধ দরজায় ধাক্কা খায়; পরিবারের বাইরে প্রথমবারের মতো বৃহত্তর পরিবেশে পদার্পণের আনন্দ যদি দাবি আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষকের কঠোর চোয়ালের ছায়ায় ঢাকা পড়ে; এর দায় কে নেবে? শিক্ষার্থী এবং সামগ্রিক অর্থে শিক্ষা ব্যবস্থার ভালো-মন্দের প্রতি শিক্ষকের সুবিবেচনাই প্রত্যাশিত। এও আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে যে, বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদ এক দফা অর্থাৎ জাতীয়করণের দাবি আদায়ে টানা ছয় মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তার মানে, প্রাথমিক পর্যায়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা এই বছরের প্রথমার্ধজুড়ে ব্যাহত হবে! আগামী বাজেটে সরকারিকরণের অর্থ বরাদ্দ না হলে তারপর থেকে 'অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট' আহ্বানের সিদ্ধান্তও মেনে নেওয়া কঠিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর এই বক্তব্য আমরা সমর্থন করি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কোনো আন্দোলন সমর্থনযোগ্য নয়। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাইয়ের যে বিষয়টি তিনি নির্দেশ করেছেন, তাও আমলযোগ্য। আমরা বলব নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার কথাও। চড়া মূল্য দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি নেওয়াও অনেক সময় হতাশার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের রাষ্ট্রীয় সামর্থ্যের কথাও নিশ্চয়ই সন্মানিত শিক্ষকরা ভুলে যাবেন না। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য সরকার বছরে রাজস্ব খাত থেকে ৫৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। এর সঙ্গে প্রতিবছর আরও ৪২০ কোটি টাকা যোগ করার যে দাবি শিক্ষকরা তুলেছেন, তা মেটানো কিন্তু সহজ নয়। এই প্রসঙ্গে আমরা শিক্ষার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত পৃষ্ঠপোষকতার ধারাটিও ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিতে চাই। এককালে বাংলাদেশে এটিই ছিল মূলধারা। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও প্রথমে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে কেন সেটা সরকারি স্বীকৃতি ও সুবিধা ছাড়া চলতে পারে না, এ বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান জরুরি। তবে সবকিছু আগে মনে রাখা জরুরি যে, শিক্ষা কার্যক্রম সবকিছুর ঊর্ধে। যে কোনো মূল্যে এটা অব্যাহত রাখতে হবে। এই সত্য শিক্ষকদের চেয়ে কে বেশি বুঝবেন?

No comments

Powered by Blogger.