প্রচ্ছদ রচনা : ছাত্রলীগ!-যেন আওয়ামী লীগের পতনঘণ্টা!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কুয়েটসহ দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ বেপরোয়া আচরণে মেতে উঠেছে। তারা পিটিয়ে মেরে ফেলছে তাদের সংগঠনের ছাত্রকেই। জাবির ছাত্র প্রয়াত জুবায়ের আহমদের মা এখন বুক চাপড়ে প্রশ্ন রাখছেন_'তোমরা কার বুক খালি করেছ।' ছাত্রলীগের এ ধরনের বেপরোয়া আচরণে আশ্চর্যরকম নিস্পৃহ ভূমিকায় আছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।


আওয়ামী লীগ নেতারা তিরস্কারের মধ্যেই তাঁদের কর্তব্য শেষ করছেন। সাধারণ মানুষের মনে এখন প্রশ্ন, তাহলে কি আওয়ামী লীগের পতনঘণ্টা ছাত্রলীগের হাতেই বাজবে? ছাত্রলীগের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন
বয়স ১৬ কি ১৭। ঠিকমতো দাড়ি-গোঁফ গজায়নি। তার পরও ক্লিন শেভড। চোখে কালো চশমা। গলায় একটি টাইও ঝোলে। তার মাথার ওপর এক পাশে শোভা পায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। অন্য পাশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। পাশে স্থানীয় এমপি বা মেয়রের বড় একটা ছবি। দেশের রাজপথে, আনাচ-কানাচে, অলিগলিতে এখন এ ধরনের পোস্টারের ছড়াছড়ি। পোস্টারের ভাষা হিসেবে লেখা থাকে_'ছাত্রলীগের ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অমুক এমপির পক্ষ থেকে ছাত্রলীগ তমুক শাখার কোষাধ্যক্ষ বা দপ্তর সম্পাদকের সালাম নিন।'
১৬-১৭ বছরের একটা ছেলে যে কলেজের প্রথম বর্ষের ক্লাস করতে যাওয়ার জন্য বাবার কাছ থেকে যাতায়াত খরচ নেওয়ার কথা, সে ছাপায় পোস্টার। এক-দুই শ পোস্টার নয়, হাজার হাজার পোস্টার। নিজ এলাকা ছাপিয়ে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় পুরো জেলা।
পোস্টার ছাপানোর খরচ কোথা থেকে এলো_১৬ বছরের ছাত্রলীগ নেতাকে এ প্রশ্ন করার সাহস কারো নেই। বরং জাতির জনক ও প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষী রেখে স্থানীয় এমপির ঢাউস সাইজের ছবিটি ছাপানোর জন্য ছাত্রলীগ নেতাটি বাহবা পায় এমপির, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পরিবার থেকে সে পায় সবচেয়ে বড় বাহবা। বাবা তাকে ডেকে বলেন, 'পোস্টারে শেখ মুজিবের অমুক ছবিটা দিলে ভালো হতো, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ছবিটা আরেকটু বড় দিলি না কেন?' বোন ডেকে বলে, 'ভাইয়া, তুই ছাত্রলীগ করস বলেই আমি ইভ টিজিংয়ের মুখে পড়ি না।' শুধু মা-ই ছেলের নেতা হয়ে ওঠাকে ভয় পান। মনে মনে বিধাতাকে ডাকেন_'হে সর্বশক্তিমান, আমার নাড়িছেঁড়া ধনটির বয়স কম। তাই একটু বেপরোয়া। তুমি তাকে রক্ষা করো মাবুদ।'

ছাত্র মানেই ছাত্রলীগ
এখন যার বয়স ১৬ সে ছাত্রলীগ, যার বয়স ৪৮ সেও ছাত্রলীগ। একটা রংচটা জিন্সের প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি শরীরে চাপাতে পারলেই পরিচয় ছাত্রলীগ। ক্লাসরুম ছাড়া সর্বত্র বিরাজমান ছাত্রলীগ। ফুটপাতের যে মুচি, সে যেমন হিসাবে রাখে ছাত্রলীগকে, তেমনি প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারও লাভের একটা অংশ ধরে রাখে ছাত্রলীগের জন্য। মানুষ মেনেই নিয়েছে, ছাত্রলীগকে বখরা না দিয়ে কোনো কাজই হবে না। কিন্তু মানুষ বিভ্রান্ত কত ধরনের ছাত্রলীগকে বখরা দিতে হবে তা নিয়ে। সভাপতি গ্রুপকে বিদায় করতে না করতেই হাজির হয় সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ। সে গ্রুপকে কিছু একটা দিয়ে বিদায়ের আগে হাজির কলেজের ভিপি গ্রুপ, জিএস গ্রুপ। তারপর থানা ছাত্রলীগ, তারপর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ, তারপর ওয়ার্ড ছাত্রলীগ। সব গ্রুপকেই সবাই খুশি রাখে। আর এই খুশি রাখতে গিয়ে চাপ পড়ে দ্রব্যমূল্যের ওপর। মূল্যস্ফীতি বাড়তেই থাকে। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে জনগণ।
সমস্যা ছিল না ছাত্রলীগের বেপরোয়া বখরা আদায়ে। সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়িতে মেতে ওঠে। কেন তার এলাকা থেকে বখরা আনতে গেল বা চাঁদা আনার তুই কে_এই ইস্যুতে যখন অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু হয়, লঙ্কাকাণ্ড বাধে, রক্তারক্তি ঘটে, তখন মানুষ শিউরে ওঠে। হু হু করে বিলাপ ওঠে কোনো মায়ের বুকের গহিন থেকে। যেমন করে এখন বিলাপ করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭তম ব্যাচের স্নাতক চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা শেষ করা জুবায়ের আহমেদের মা হাসিনা আহমেদ।
জুবায়েরকে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির হত্যা করেনি। জুবায়ের সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়ে হত্যার শিকার হননি, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা জুবায়েরকে মারেনি, পুলিশ, র‌্যাব কিংবা কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের টার্গেট হয়ে জুবায়ের খুন হননি। জুবায়ের যে ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন, যে সংগঠনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে জুবায়ের মিছিল-মিটিং করতেন, চা-স্টলে বসে চা খেতেন, আড্ডা দিতেন, সেই সংগঠনের সদস্যরাই জুবায়ের আহমেদকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সংগঠনটির নাম ছাত্রলীগ।
জুবায়েরের মা কান্নায় ভেঙে পড়া কণ্ঠে এখন প্রশ্ন রাখছেন_'তোমরা কার বুক খালি করেছ।' প্রশ্নটি ব্যাপক, উত্তর বিস্তৃত। জুবায়েরের বাবা তোফায়েল আহমেদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন রাখছেন, 'আমার ছেলেকে কেন মারল, তার দোষ কী।' এই প্রশ্নটিও ব্যাপক, উত্তর আরো বিস্তৃত।
বুক খালি হওয়া মা-বাবা এর চেয়েও কঠিন প্রশ্ন করতে পারেন। করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর কী সদুত্তর দেবে ছাত্রলীগের মূল সংগঠন আওয়ামী লীগ। অতীতে ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ তার ছাত্র সংগঠনের বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যা করেছে, তার নাম 'তিরস্কার'। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কী জানে, ছাত্রলীগ তিরস্কারকে 'পুরস্কার' হিসেবে জ্ঞান করে। পত্রিকায় নাম উঠেছে বলে গর্বে গদগদ হয়। যে কমিটির নামে অভিযোগ ওঠে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ত্বরিত সে কমিটি ভেঙে দেয়। যে ছাত্রলীগ নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, বড়জোর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। আবার কিছুদিন পর কোনো সম্মেলন বা সভা উপলক্ষে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ফলে বহিষ্কার করার আগে যে ছাত্রলীগ থাকে বেপরোয়া, বহিষ্কার করলে সে হয়ে ওঠে শান্ত, আর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করলে সে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে হয়ে ওঠে কঠিন বেপরোয়া। এমন বেপরোয়া যে সে নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করতে পর্যন্ত কসুর করে না। করবেই বা কেন? কারণ সে বছরের পর বছর ধরে দেখে এসেছে, দলীয় কোন্দলে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কোনো কালেই কোনো বিচার হয়নি।
অথচ যদি বিচার হতো, হত্যাকারীরা শাস্তি পেত, তাহলে নব্য হত্যাকারীরা প্রমাদ গুনত। কিন্তু হত্যাকারীরা দেখেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ বছরে যে ৭৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তার কোনোটিরই বিচার হয়নি। এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ছাত্রদল-ছাত্রলীগ, ছাত্রদল-ছাত্রদল, ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা হত্যার নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল হত্যার হোলিখেলায় মেতে ওঠে, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ গ্রহণ করে হত্যার নেতৃত্ব।

টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের কমিটি
ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে কারা স্থান পায়, কিভাবে পায়, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে আছে শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির কথা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি গঠনের সময় এই তিনটি মূলমন্ত্রের কয়টি বিবেচনায় রাখে? অভিযোগ উঠেছে, এই তিন মূলমন্ত্রকে ফাইলবন্দি করে কমিটি গঠনের সময় চলে টাকার খেলা। ছাত্র হোক, অছাত্র হোক, ছাত্রত্ব না থাকুক_যে বেশি টাকা দিতে পারে সে-ই স্থান পায় কমিটিতে। কমিটিতে ঢোকার জন্য একজন ছাত্র যত টাকা বিনিয়োগ করে, তার ২০ গুণ তুলে নিতে চায় এক বছরে। ফলে তাকে হতে হয় বেপরোয়া। বিষয়টি ছাত্রলীগের জন্য যেমন প্রযোজ্য, ছাত্রদলের জন্যও তেমনি।
ছাত্রলীগ নামের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়টি এখন বেশ আলোচনার বিষয়। সরকারের বাকি আছে দুই বছরেরও কম সময়। বলা হচ্ছে, এই সময় যত কমতে থাকবে, ছাত্রলীগ ততই বেপরোয়া হয়ে উঠবে। কারণ সরকারে আওয়ামী লীগ থাকায় ছাত্রলীগের কথায় এখন ওঠে-বসে প্রশাসন। কোনো একটা ঘটনা ঘটলে প্রশাসন আগে জানতে চায়, ওই ঘটনার নেপথ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছাত্রলীগ আছে কি না। যদি থাকে তাহলে ঘটনার ট্রিটমেন্ট হয় এক রকম, না থাকলে অন্য রকম। একজন পুলিশ অফিসার একজন মাদকসেবীকে আটকের আগে জানতে চায় সে ছাত্রলীগ করে কি না, কোনো মামলায় আসামির খাতায় নাম ওঠানোর আগে পুলিশ সর্বতোভাবে বিবেচনায় রাখে, ওই আসামি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কি না।
ছাত্রলীগ বিষয়টি বোঝে। সে দিব্যচক্ষু দিয়ে দেখে, থানার ওসি ও এসআই তাকে তোয়াজ করেন। ইউএনও পিঠে চাপড় মেরে হাসি-হাসি মুখে কথা বলেন। ডিসি তাদের নিয়ে আলোচনা সভায় বসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাদের নিয়ে গর্ববোধ করেন। ফলে সে সুযোগ গ্রহণ করে। কত দ্রুত কত অর্থ কামানো যায়, তা-ই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান। সে এ-ও বোঝে, তার দল ক্ষমতায় না থাকলে যারা আজ তাদের তোয়াজ করছেন, তারাই তাদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করবেন। ছাত্রলীগ যেমন বোঝে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসন তার; ছাত্রদলও তেমনি বোঝে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসন তার। কিন্তু ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের কেউই বুঝতে চায় না, প্রশাসন আসলে কারো নয়। যদি বুঝত, তাহলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দখলে রাখা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের হল ছেড়ে দিতে হতো না। পাঁচ বছরের জন্য গর্তে লুকিয়ে পড়তে হতো না। যেমনটি এখন লুকিয়েছে ছাত্রদল। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এখনো সুযোগ রয়েছে, সারা দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজানোর। শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পথে ছাত্রলীগকে উজ্জীবিত করার। এটা সম্ভব হবে তখনই, যখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নৈতিক অবক্ষয় থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবেন। অবক্ষয়মুক্ত ছাত্র নেতৃত্বই পারে সারা দেশে সুশীল ছাত্রলীগ সমাজ তৈরি করতে। আগামী দুই বছরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি নিজেদের ও অন্যদের শোধরাতে না পারেন, তাহলে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী গর্তে লুকিয়ে পড়তে হবে। চিরায়ত নিয়মের এই অর্গল ভাঙতে হবে ছাত্রলীগকেই। কারণ দেশের সর্বপ্রাচীন সংগঠন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটিরই একমাত্র সে ধরনের সক্ষমতা আছে।

আওয়ামী লীগের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী ইশতেহার
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিল, তাতে অনেক ঘোষণার মধ্যে একটি ছিল_নির্বাচনে জয়লাভ করলে দলটি দেশের শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাসমুক্ত রাখবে। তিন বছর পর এখন বিশ্লেষণের দাবি রাখে, আওয়ামী লীগ শিক্ষাঙ্গনকে কতটুকু সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে পেরেছে? গত তিন বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও দলীয় কোন্দল এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার অঙ্গীকারটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিস্পৃহতা নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে নিত্য সংঘর্ষ। সেখানে ছাত্রলীগ ভিসির পক্ষে স্লোগান তুলছে, 'ভিসি তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।' শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে লাঞ্ছিত করছেন প্রক্টর। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিজেরা নিজেরা মারামারি করেছে ১৯ বার। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা চালিয়েছে ১০ বার। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে মারামারিতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এক মাস ধরে বন্ধ আছে ছাত্রলীগের পরস্পরের মারামারিতে। সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মেতেছে ধর্ষণ উৎসবে। তারা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে এনে একজন নৃত্যশিল্পীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগ কমিটি ভেঙে দিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেছে।
ছাত্রলীগের ৮৭টি জেলা কমিটি রয়েছে। সাতক্ষীরার কমিটি ভেঙে দেওয়ায় এখন এই সংখ্যা ৮৬। সাতক্ষীরায় যা ঘটেছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুধাবন করা দরকার, অন্যান্য জেলা কমিটিতেও একই ঘটনা ঘটছে কি না। পুলিশের তৎপরতায় সাতক্ষীরার ঘটনাটি প্রকাশ হয়েছে এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায় সাতক্ষীরা জেলা কমিটি ভেঙে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ দায়িত্ব শেষ করেছে। সব ঘটনাই সব সময় প্রকাশ হয় না এবং কমিটি ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছাত্রলীগ শাসক দলের গরমে দেশের আনাচ-কানাচে এ রকম বহু ঘটনা ঘটাচ্ছে, যা প্রকাশিত হয় না। কিন্তু মানুষ এসব মনে রাখে। আমজনতার সুযোগ বারবার আসে না। কালেভদ্রে আসে। সেই সুযোগ আমজনতা ভালোভাবেই প্রয়োগ করে সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এখনই বুঝতে হবে, ছাত্রলীগের সর্বগ্রাসী এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে না পারলে সামনে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে মহাবিপদ। গত তিন বছরে আওয়ামী লীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাসের ডালপালা বিস্তৃত হতে দেয়নি। গত তিন বছরে সারা দেশে একজন গডফাদারও সৃষ্টি হয়নি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মানুষ মেনে নিয়েছে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে। কৃষি উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন থাকার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও মানুষ মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগ যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, তা আমজনতা মেনে নিলেও ছাত্রলীগের 'বেয়াদবি' মেনে নেয়নি। ছাত্রলীগের আতঙ্কে আতঙ্কিত মানুষ। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্দেশে এখন বলার সময় এসেছে, নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তত 'শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাসমুক্ত' রাখার ঘোষণাটি বাস্তবায়ন করুন। নইলে আগামী নির্বাচনে ছাত্রলীগ 'বিষফোড়া' হয়ে আওয়ামী লীগকে দংশন করবে।

আওয়ামী লীগের পতনঘণ্টা যেন না বাজায় ছাত্রলীগ
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহুবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। সে বিপর্যয় তারা আবার কাটিয়েও উঠেছে। তবে প্রমাণিত সত্য যে ছাত্রলীগের কারণে আওয়ামী লীগকে কখনো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হয়নি। ছাত্রলীগের অতীত ইতিহাস স্বর্ণোজ্জ্বল। কিছুদিন আগে প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক সে প্রমাণ রেখে গেছেন। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের জানাজায় অংশ নিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে। শুধু আবদুর রাজ্জাকই নন, তাঁর মতো বহু ছাত্রলীগ নেতাকে মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে তাঁদের নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে। কিন্তু হায়, ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে সে গুণাবলি কোথায়?
ওয়ার্ড থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত ছাত্রলীগ এখন যা করছে, তাতে আওয়ামী লীগের নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। তাঁরা কিছু বলতেও পারছেন না, সইতেও পারছেন না। আওয়ামী লীগের নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন ছাত্রলীগের ঔদ্ধত্যের কাছে। তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের এই জনবিচ্ছিন্নতায় দলটির মৃত্যুঘণ্টার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
ছাত্রলীগ যাতে আওয়ামী লীগের মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। উপদেশ, তিরস্কার, বহিষ্কার নয়; আইনি ব্যবস্থাই পারে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরতে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ায় যত কঠোরতা দেখাবেন, ততই লীগের জন্য মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.