পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য খালাস!-চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস by সারোয়ার সুমন

কে বা কারা জালিয়াতির মাধ্যমে আমাদের আইডি নম্বর এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে উত্তরা নিটওয়্যারস লিমিটেডের নামে গত ১৫ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে দুটি রফতানি চালান বি/ই নোটিং করে, যা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নয়।' এমন ভয়ঙ্কর জালিয়াতির কথা উল্লেখ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এইচআর এন্টারপ্রাইজ।


ব্রিটেন যাওয়ার কথা থাকলেও চিঠি পেয়ে সংশ্লিষ্ট দুটি চালান আটকে রাখে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। শুল্ক পরিশোধের জাল কাগজপত্র বানিয়ে খালাস করার চেষ্টাকালে পৃথক আরও দুটি ঘটনায় আটক করা হয় সাত কনটেইনার পণ্য। তবে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জালিয়াত চক্র শুল্ক না দিয়েই ১১ কনটেইনার পণ্য মাসখানেক আগে খালাস করে নিয়ে যায়। মাসে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হওয়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে হঠাৎ করে সংগঠিত এতসব জালিয়াতির ঘটনা
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অটোমেশন কার্যক্রমকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
এদিকে জালিয়াতির এসব ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। দায়ীদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে বলে জানালেন কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. মতিউর রহমান। তিনি বলেন, 'হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট। এদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে বন্দরের আটটি গেটে নজরদারি বাড়ানো হবে। নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী কিংবা তার প্রতিনিধি ছাড়া কেউ যাতে পণ্য খালাস করতে বন্দরে ঢুকতে না পারে সেজন্য প্রক্সিমিটি কার্ড ইস্যু করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।' অটোমেশন কার্যক্রমের দুর্বলতায় এমন জালিয়াতি হচ্ছে কি-না জিজ্ঞেস করলে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, 'অটোমেশন আছে বলেই জালিয়াতির ঘটনা ধরতে পারছি আমরা। শুল্ক না দিয়ে কেউ যদি পণ্য খালাস করে নিয়ে যায়, তবে তার দায় কাগজপত্র যাচাই-বাছাইকারী কর্মকর্তার, অটোমেশন প্রক্রিয়ার নয়।'
উল্লেখ্য, গত বছরও চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্ক জালিয়াতি করে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে শত কোটি টাকার পণ্য। এ ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করতে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু এখনও সেই টাস্কফোর্স এ ব্যাপারে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিতে পারেনি। চিহ্নিত করা যায়নি চট্টগ্রাম কাস্টমসে গত কয়েকদিনের জালিয়াতির ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদেরও।
পাসওয়ার্ড জালিয়াতি : চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ এলাকার সিঙ্গাপুর মার্কেটের চতুর্থতলায় মেসার্স এইচআর এন্টারপ্রাইজের অফিস। কাস্টমসে তাদের এজেন্ট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (এআইএন) ৩০১৮৪১৫৬৯। গত ১৫ জানুয়ারি তাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোনো পণ্য চালানের বিল অব এন্ট্রি (বি/ই) নম্বর দাখিল করা হয়নি। কিন্তু তাদের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ৫১৭১০১৭০৭৮ বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী (বিআইএন) উত্তরা নিট ওয়্যারস লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান পৃথক দুটি চালানে পণ্য রফতানির কাগজপত্র জমা দেয়। রেজিস্ট্রেশন নম্বর সি-২৮১৩২ ও ২৮১৩৩ চালানে এসব পণ্য ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এইচআর এন্টারপ্রাইজ তাদের কার্যক্রমের দৈনন্দিন রুটিন লিস্ট পর্যালোচনা করলে তাদের অজান্তে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে দুটি পণ্য চালান কাস্টমসে জমা পড়ার তথ্য পান। তাই গতকাল সোমবার অতিরিক্ত কাস্টমস কমিশনারকে বিষয়টি অবহিত করে পত্র লেখেন তারা। চিঠিতে গাজীপুর জেলার কাশিমপুর জিরানী বাজার এলাকার উত্তরা নিট ওয়্যারস লিমিটেডকে এজন্য দায়ী করে তাদের সংশ্লিষ্ট চালান আটক করারও অনুরোধ জানান তারা। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম কাস্টমসে অটোমেশন কার্যক্রম চালু হওয়ার পর ব্যবসায়ীরা এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই পণ্য আনা-নেওয়া করছে। গুরুত্বপূর্ণ এ পাসওয়ার্ড ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাই চিন্তিত ব্যবসায়ীরাও। কারণ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিমাসে গড়ে দুই হাজার কোটি টাকার শুল্ক দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য আনা-নেওয়া করছে ব্যবসায়ীরা।
আটক করা হয়েছে সাত কনটেইনার পণ্য : জাল কাগজপত্র বানিয়ে পণ্য খালাস করে নিতে তৎপরতা শুরু করেছে একটি চক্র। গত মাসে কোটি টাকা দামের ১১ কনটেইনার রাসায়নিক শুল্ক না দিয়ে খালাসও করে নিয়ে যায় তারা। গত শনিবার বিষয়টি জানাজানি হলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক নিউ সেভেন স্টার কেমিক্যাল ও তাদের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান এঅ্যান্ডএস এজেন্সি গতকাল সোমবার প্রায় এক মাস পর সাড়ে ৬৮ লাখ টাকার শুল্ক পরিশোধ করে। তবে পৃথক আরও তিনটি চালানে আনা এ প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি কনটেইনার আটক করে রেখেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এর মধ্যে তিন হাজার ৯০০ ব্যাগ করে পুমাইচ স্টোন আছে ৪০ ফুটের তিনটি কনটেইনারে। ২০ ফুটের দুটি কনটেইনারের একটিতে আছে অক্সালিক এসিড। এমন ঘোষণা থাকলেও সন্দেহভাজন হওয়ায় এসব কনটেইনার শতভাগ কায়িক পরীক্ষা ছাড়া খালাসের ছাড়পত্র না দিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এদিকে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের আরও দুটি কনটেইনার সিলগালা করে দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ঢাকার নবাবপুর রোডের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রিয়া ইলেকট্রনিক্স এসব কনটেইনার খালাস করতে দায়িত্ব দিয়েছিল সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান সুজন ট্রেডিংকে। শুল্ক না দিয়েই বন্দর থেকে এসব কনটেইনার খালাস করা হচ্ছে_ এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কনটেইনার দুটি সিলগালা করে রাখে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি স্বীকার করে কাস্টমসের এআইআর শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা অরিন্দম চাকমা বলেন, 'ইলেকট্রনিক্স স্পেয়ার পার্টস ঘোষণা দিয়ে এ দুটি কনটেইনারে কী আনা হয়েছে তা পরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে শুল্ক না দিয়েই বন্দর থেকে গোপনে এসব কনটেইনার খালাস করা হবে_ এমন গোপন দিয়েছেন আমাদের কমিশনার মহোদয়। তাই তার নির্দেশে সন্দেহভাজন দুটি কনটেইনারই সিলগালা করে দিয়েছি আমরা।'

No comments

Powered by Blogger.