ফিরে দেখা : বিএনপির তিন বছর-আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাই বড় সম্বল by মাহাদিউদ্দিন আজমীর

জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিরও পূর্ণ হয়েছে তিন বছর। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি মহাজোট সরকার গঠন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতারও অনেক বেশি আসন নিয়ে। ফলে অনেকে ভেবেছিল, মহাজোটের জোয়ারে বিএনপি ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। অস্তিত্ব সংকটে পড়বে দলটি।
এমনও আশঙ্কা অনেকে প্রকাশ করেছিল যে একসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী মুসলিম লীগ যেভাবে টুকরো হয়েছিল, বিএনপির অবস্থাও তেমনই হবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য আশার বিষয় হলো_গত তিন বছরে বিএনপি অক্ষত আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরাট একটা অংশের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা চললেও দলটি ভেঙে যায়নি। দলের কোনো অংশ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে খালেদা জিয়ার বিকল্প নেতৃত্বের দল গঠন করতে পারেনি। বরং একসময় যাঁরা দল থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে বেরিয়ে গিয়ে ভিন্ন নামে দল গঠন করেছিলেন তাঁরা আবার বিএনপিতে ফেরার মিছিলে আছেন। কর্নেল অলির এলডিপি, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টি, শফিউল আলম প্রধানের জাগপাসহ অনেকেই বিএনপিতে ফেরার প্রক্রিয়ায়। এ জন্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের দল সংখ্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে।
জামায়াতে ইসলামী তথা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য অনেকে ভেবেছিলেন বিএনপির জনপ্রিয়তর পারদ ক্রমেই নিচের দিকে নামতে থাকবে। এখানেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য আশার বিষয় হলো_বিভিন্ন পত্রপত্রিকার করা জরিপে তাদের জনপ্রিয়তা যেখানে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২৫ শতাংশ, তা ২০১০-এ বেড়ে হয়েছে ৩৯ শতাংশ। আর ২০১১ সালে জনসমর্থন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছরের মধ্যে প্রতিবছরই বিএনপি তাদের জনসমর্থন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
তবে দেখার বিষয় হলো, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে তাদের জনসমর্থন বেড়েছে, না অন্য কোনো কারণে। এ কথা সত্য, বিএনপি গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের মতো হরতালচর্চা করেনি। এটা জনগণ খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে। যেখানে বিএনপির নব্বই-পরবর্তী প্রথম শাসনামলের শেষ বছরে আওয়ামী লীগ ১৬২ দিন হরতাল ডেকেছে, সেখানে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শাসনামলের প্রথম তিন বছরে বিএনপি হরতাল করেছে মাত্র ১০ দিন। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, মহাজোট সরকার গঠনের দেড় বছর পর ২০১০ সালের ২৭ জুন বিএনপি প্রথম হরতালের ডাক দেয়। এরপর তারা বিভিন্ন সময় আরো ৯ দিন হরতাল পালন করে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে তিন দিন এবং দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাকি ছয় দিন হরতাল পালন করে। হরতাল সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বিএনপি গত তিন বছরে জনসভা, মহাসমাবেশ, লংমার্চ, রোডমার্চের মতো কর্মসূচিতে মনোনিবেশ করে। তিন বছরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অন্তত ১৫টি জনসভা, মহাসমাবেশ ও বিভাগীয় সমাবেশ করেন। এ সময় বিএনপি রোডমার্চ করে চারটি, যা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আর এসব ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে বিএনপির জনসমর্থনের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হয় বলে রাজনীতিবোদ্ধারা ধারণা করেন। তবে তাঁরা এও ধারণা করেন যে বিএনপির নেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপে তাঁদের জনসমর্থন যতটুকু বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে শাসকদল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায়।
মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে অনুষ্ঠিত হয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং কিছু সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এসব নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় এবং অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি মহাজোটের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে মোট উপজেলার প্রায় অর্ধেকে জয়লাভ করে। পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি জয়লাভ করে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রায় ধরাশায়ী হন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জাঁদরেল প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন বিএনপি প্রার্থী মঞ্জুরুল আলম। নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আইভী রহমান জয়লাভ করলেও কৌশলগত দিক থেকে আওয়ামী লীগ মার খায় বিএনপির কাছে। সর্বশেষ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আফজল খান প্রায় ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন সাক্কুর কাছে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নাগরিক ফোরামের ব্যানারে নির্বাচন করলেও কুমিল্লাবাসী সবাই জানে সাক্কু বিএনপিরই নেতা।
গত তিন বছরে বিএনপির সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নয়। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি জাতীয় সংসদে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে জাতীয় সংসদের মোট ২৫৪ কার্যদিবসের মধ্যে বিএনপি উপস্থিত থাকে মাত্র ৫৪ দিন। ২০০ দিনই তারা সংসদে অনুপস্থিত থাকে। এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সংসদে তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। তাঁদের এ অভিযোগ প্রমাণিত সত্য হয়নি।
কারণ বিএনপি চেয়ারপারসন ৫৪ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র ছয় কার্যদিবস জাতীয় সংসদে উপস্থিত হন। এই ছয় দিনে তিনি সংসদে ভাষণ দেন চার ঘণ্টা ৩৪ মিনিট।
বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি বর্তমানে সংসদে অনুপস্থিত আছে। ২০১১ সালের ১৫ মার্চের পর তারা আর সংসদে যায়নি। আসন্ন শীতকালীন অধিবেশন যদি এক মাসের বেশি সময় ধরে চলে এবং বিএনপি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তাদের অধিকাংশ সংসদ সদস্যের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য পদ টিকিয়ে রাখার জন্য বিএনপি যদি শীতকালীন অধিবেশনে যোগ দেয়, তাহলে তা হবে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত।
গত তিন বছরে বিএনপির জামায়াত সম্পৃক্ততা না কমে বরং বেড়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে কোণঠাসা করার জন্য যেখানে মহাজোট যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে, সেখানে রোডমার্চ শেষে বিভাগীয় মহাসমাবেশে খালেদা জিয়া জামায়াত নেতাদের নাম উচ্চারণ করে তাঁদের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, যা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।
সার্বিকভাবে বলা চলে, গত তিন বছরে বিএনপি জনগণের অনেক কাছে যেতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের গৃহীত পদক্ষেপের সফলতা যতটুকু তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা। গত তিন বছরের মতো আগামী দুই বছর যদি বিএনপি তাদের জনসমর্থন বাড়ানোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে, তাহলে শাসকদল আওয়ামী লীগ আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে। জনগণ যেসব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন, যেমন_টিপাইমুখ বাঁধ, ঢাকাকে দুই ভাগ করা ইত্যাদির মতো ইস্যুতে যদি বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন চালাতে পারে, তাহলে এর ফল আগামী নির্বাচনে তারা পাবে। আর যদি জনসমর্থনহীন ইস্যুতে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়, তাহলে হানাহানি বাড়বে, নতুন আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসার পথ প্রশস্ত হবে।

No comments

Powered by Blogger.