মোটামুটি by ফ্লোরা সরকার

কার্ল মার্কসের উরধষবপঃরপধষ গধঃবত্রধষরংস বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সম্পর্কে যাদের অল্প-বিস্তর পরিচয় আছে তারা সবাই জানেন কোনো তত্ত্ব, তথ্য, উপাত্ত, অ-কথ্য (যা কথিত বা বলা হয়নি) বা কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্বন্ধ (যে সম্পর্কে বলা হয়নি) যা-ই উপস্থাপন করা হোক না কেন সেটা যদি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয় তাহলে সেই তত্ত্ব বা প্রবন্ধের একটি নির্দিষ্ট সত্যে উপনীত হওয়ার ‘সম্ভাবনা’ থাকে।
‘সম্ভাবনা’ এই কারণে যে, প্রমাণিত সত্যের সত্যতা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির পথ পরিক্রমার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কেউ যদি আগেই তার পূর্বাহ্নে স্থির করা সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে এগোয় তাহলে থিসিস, অ্যান্টিথিসিসের সিঁড়ি বেয়ে যখন সিনথেসিসে অবতরণ করবেন তখন ‘সম্ভাবনার’ জালে জড়িয়ে যেতে পারেন। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দ্বন্দ্বেই শুধু দুলতে থাকতে হবে। সত্যে উপনীত হওয়া আর হবে না। কারণ, সম্ভাবনা মানে কোনো স্থির সত্য বা সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া। সম্ভাবনা মানে মোটা আর মুটির দোলাচলে দোল খাওয়া। মনের ভেতর কেমন খচ্ খচ্ করা। কিন্তু কী বিস্ময়কর রকমের সত্য যে, আমাদের জীবন এখন অনেকটা এরকম এক অদ্ভুত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে এগুচ্ছে। যার সঙ্গে মার্কস কথিত দ্বান্দ্বিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে একটা কথা—এই না থাকার কারণে কোনো আফসোস বা দুঃখবোধ করা হতো না যদি না সত্যের সত্য চেহারাটা সত্যি সত্যি দেখতে পেতাম। কারণ, আমাদের জীবনের সত্যগুলো এখন ছোট ছোট সড়ষবপঁষব বা অণুতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি একজনের কাছে যা সত্য অপরের কাছে তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা যেন সত্য-মিথ্যা সব গুলিয়ে ফেলছি। জোহান বোয়ার তার বিখ্যাত উপন্যাস 'ঞযব ঢ়ড়বিত্ ড়ভ ষরব'-এ তবু একটা দর্শনের ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছিলেন, যেখানে একটা মিথ্যাকে বারবার সত্য বলে প্রচারিত করলে সেটা কীভাবে সত্য হয়ে যায়। মিথ্যার শক্তিশালী রূপটি তিনি তার উপন্যাসের কাহিনীতে দেখিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বেলায় সত্য বা মিথ্যা কোনোটাই শক্তিশালী নয়, দুটোই যেন দুর্বল। শুধু তাই না—একটা সত্য যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় তখনি আরেকটা মিথ্যা এসে তাকে চাপা দিয়ে সত্য বানিয়ে তোলে। তখন আরেক ধরনের সত্য দেখা দেয়। আবার সেই সত্য দেখা দিতে না দিতেই আরেকটা বা পুরনো মিথ্যা এসে তাকে ঢেকে দেয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো নানা বর্ণের, নানা আকারের একের পর এক সত্য-মিথ্যা ঢেউগুলো যেন পরপর ভেসে ওঠে আবার ডুবে যায়। সত্যকে তো চেনা যায়-ই না, মিথ্যাকেও না। এরকম অবস্থা শুধু বিব্রতকরই নয়, চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। কিন্তু এরকম পরিস্থিতি কোনো সমাজে কি একদিনে গড়ে ওঠে? অবশ্যই না। তাহলে কোত্থেকে এল?
সমাজের কিছু প্রচলিত, বহু ব্যবহৃত শব্দ বা শব্দ সমষ্টি দিয়ে সেই সমাজের সামাজিক চরিত্রকে অনেকটা অনুধাবন করা যায়। যেমন আমরা কাউকে যখন জিজ্ঞেস করি কাজটা কতদূর এগিয়েছে, অনেক সময় বলতে শোনা যায়—‘মোটামুটি’, পরীক্ষা কেমন হয়েছে? ‘মোটামুটি’, দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ‘মোটামুটি’। এখন প্রশ্ন একটাই—এই মোটামুটি শব্দ দিয়ে কী বুঝি আমরা? এই যে কাজটা মোটামুটি এগিয়েছে বা পরীক্ষা মোটামুটি হয়েছে বলতে কী বোঝানো হয়? চটজলদি একটা উত্তর আমরা পাই ভালো-মন্দের মাঝামাঝি। অর্থাত্ খুব ভালোও না আবার খুব খারাপও না। কিন্তু ভালো ভালোর সঙ্গে, মন্দ মন্দ পাশাপাশি থাকে কী করে? তাই কি হয় কখনও? কারণ ভালোর বিপরীত শব্দ মন্দ। কাজটা বা পরীক্ষাটা হয় ভালো হয়েছে বা মন্দ হয়েছে। দুটোর মাঝামাঝি তো হতে পারে না। আচ্ছা যুক্তির খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম মোটামুটি শব্দটি ভালো আর মন্দের মাঝামাঝি একটা অবস্থানের কথা বোঝানো হয়েছে। আর ঠিক তখনই এই মাঝামাঝি অবস্থান আমাদের বিপদের অশনিসংকেত শুনিয়ে দেয়। আমাদের চরিত্রের দুর্বল অবস্থার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমাদের মেরুদণ্ডহীনতা প্রকাশ করে দেয়। কি করে?
যে মাঝে থাকে সে আসলে কারোর সঙ্গেই থাকে না। থাকতে পারে না। দু’দিক থেকেই সে বিচ্ছিন্ন থাকে। তা না হলে বিশিষ্ট সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান তার সংস্কৃতির ভাঙা সেতুকে কেন বলবেন, আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন? শুধু কি বিচ্ছিন্ন? ভালো-মন্দের মাঝামাঝি অবস্থান কি অস্পষ্টতার একটা ইঙ্গিত বহন করে না? কেমন যেন নিজেকে সব কিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখার একটা কূটবুদ্ধি? কেমন যেন সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া? কী যেন গোপন করার একটা অভিসন্ধি? কাজটা বা পরীক্ষাটা যেহেতু ভালো হয়নি সেটা গোপন করার জন্যই মাঝামাঝি এই মোটামুটি শব্দটা ব্যবহার করা? কিন্তু কেন?
উনিশ শতকের অন্যতম রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিপিন চন্দ্র পালের একটা চমত্কার উক্তি দিয়ে বিষয়টা শুরু করা যাক। উক্তিটি হচ্ছে—“আমাদের ব্যক্তিত্ব বিদেশি টবে গঠিত হয়েছে, না, ঠিক টবেও না, অর্কিডের মধ্যে। আমাদের পৌরুষ বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা ব্যক্তিত্ব”। অর্থাত্ যে ব্যক্তিত্ব না পারে আকাশকে ছুঁতে, না পারে মাটিকে অর্থাত্ তার শেকড়কে ছুঁতে। আর এভাবে যে জাতির ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে সেই ব্যক্তিত্বের আকৃতি, প্রকৃতি, চরিত্র কেমন হতে পারে তা সহজেই বোধগম্য। অপ্রিয় হলেও সত্য, সেই সুদূর ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান সময় পার হয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সময়েও আমরা এভাবেই বেড়ে উঠেছি এবং উঠছি। না হলে কেন আমারে মধ্যে এত শো অফ করার প্রবণতা? কেন আমরা নিজেদের স্পষ্ট করে দেখাতে পারি না? কেন পারি না বলতে—‘পরীক্ষা ভালো হয়নি। খুব খারাপ হয়েছে’। কিসের জড়তা? হ্যাঁ, আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারি না। প্রকাশ করবই বা কী করে? কারণ নিজেদের তো আজও আমরা চিনতেই পারিনি। চেনার চেষ্টাও করি না। করলে কেন এত অনুকরণ প্রবৃত্তি ফোবিয়ায় ভুগি আমরা? কেন নিজের কিছু গ্রহণ করতে পারি না? কেন নিজের যা কিছু মন্দ তা ভালো করার চেষ্টা না করে অপরের প্রতি এত পক্ষপাতপুষ্ট হই? কেন আমরা শৈশব থেকে শুনে আসি—বাংলাদেশ একটা যেনতেন দেশ। এদেশের কোনো ভবিষ্যত্ নেই। শুধু মন্দ, মন্দ আর মন্দ দিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। শুধু তাই না। আমরা কোনোভাবে, কোনোরকমে বেঁচে থাকাকে আল্লাহর অসীম করুণা মনে করি। কেন কোনোভাবে বেঁচে থাকব? কেন ভালোভাবে নয়? কিসের এত ভয়? ওই যে মোটামুটি। আমরা মোটামুটি থাকতে চাই। অর্থাত্ এত ভালো থাকার দরকার নেই। তা না হলে আমরা মানুষকে বলতে শুনি কেন—এই তো কোনোভাবে চলে যাচ্ছে আর কী। কেন? কেন কোনোভাবে? ভালোভাবে নয় কেন? জীবন কি এত হেলাফেলার কিছু? পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যদি ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারে, এত স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে আমরা কেন পারব না? তারা তো আকাশ থেকে পড়েনি বা কোনো দেবতার বর পায়নি? তাহলে?
তাহলে কী পাছে লোকে কিছু বলে সেই ভয়ে? অথবা ভালো খবর অন্যকে জানালে ঈর্ষার উদ্রেক ঘটতে পারে সেই ভয়ে? নাকি নিজের মন্দ দিকটা অন্যের কাছে পাছে ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে?
আসলে আমাদের যা বলা হয় আমরা বিনা দ্বিধায় তা মেনে নেই। কোনো প্রশ্ন করি না। করি না কারণ আমাদের কাছে কোনো প্রশ্ন নেই। আর যাদের আছে তারা সাহস করে প্রশ্ন করতে পারে না। আর তাই অফিসের বড় কর্মকর্তাটি যখন যে আদেশ করেন তা যত অবাস্তব বা অযৌক্তিক হোক আমরা মাথা পেতে তা পালন করি। তাছাড়া প্রশ্ন থাকেও না। কারণ প্রশ্ন করার কৌশল আমাদের জানা নেই। তা না হলে কেনিয়ার অন্যতম তথ্যচিত্র নির্মাতা এবং লেখক গুগি ওয়া থিয়ংও তার ‘শিল্পী ও রাষ্ট্র : সম্পর্কের টানাপোড়েন’ প্রবন্ধে কেন বলবেন—‘রাষ্ট্রের কাছে অনেক উত্তর এবং প্রায় কোনো প্রশ্ন নেই। রাষ্ট্র যত স্বেচ্ছাচারী হবে, তত নিজেকে কম প্রশ্ন করবে। তত কম অন্যের প্রশ্নকে শুনতে চাইবে’। প্রশ্ন করতে না জানলে কিছুই জানা হয় না। শেখা হয় না কিছুই। যেখানে প্রশ্ন নেই সেখানে থাকে শুধু অন্ধকার। অথচ আমরা শুধু পরীক্ষার খাতায় কিছু মুখস্থ উত্তর লিখে জীবন অতিবাহিত করে যাই বা আদেশ করেন যাহা মোর বসরা আমরা যেন তা বিনা দ্বিধায় পালন করে যাই—এই শিক্ষা নিয়েই বড় হই। কেন? ওই যে মোটামুটি। কী দরকার প্রশ্ন করে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে? তার চেয়ে মোটামুটিভাবে দিন চলে গেলেই হয়। যে জন্য স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর্ণধার পর্যন্ত কাউকে আমরা কোনো প্রশ্ন করি না। প্রশ্ন করি না ঠিক না। প্রশ্ন করার সাহস করি না। কারণ প্রশ্নের সঙ্গে নানা বর্ণের ভয় জড়িয়ে থাকে, যে ভয় মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন না করা মানে নিজের ইচ্ছাকে অনিচ্ছার কাছে বলি দেয়া। প্রশ্ন না করা মানে আমার উত্সুক মনের অবদমন ঘটানো। প্রশ্ন না করা মানে মেনে নেয়া। কিন্তু বিনা প্রশ্নে সবকিছু মেনে নেয়ার শিক্ষক তো ছিলেন সেই ব্রিটিশরাজ। তারাই আমাদের মেনে নেয়া কত প্রকারের, কত আকারের, কত রংয়ের, কত ঢংয়ের হতে পারে সব শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাই বলে কী আজও আমরা সেটাই করে যাব? যে মেনে নেয়ার অর্থ নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজের কাছে নিজেকে বলি দেয়া? ছোট করা? আর এভাবে ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকাটা কি খুব সুখকর কিছু?
সে জন্যই মোটামুটি শব্দটাকে এত ভয়। মোটামুটি থাকাকে কোনো থাকা বলা যায় না। মোটামুটি কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয় না। একটা ধোঁয়াটে জীবনযাপন করায়। দিনযাপন আর দিন গুজরান এক কথা না। দিন গুজরানোর ভেতর জীবনের কোনো স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় না। ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সব একাকার হয়ে যায়। ফলে ভালোকেও যেমন শনাক্ত করা যায় না, তেমনি যায় না মন্দকেও। আর ভালো-মন্দ বা সত্য-মিথ্যা যখন চেনা না যায়, মানুষ তখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। দিশাহারা হয়ে যায়। দিশাহারা জাতির কী করুণ পরিণতি হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই আর খুলে বলার দরকার নেই। তাই আসুন, আমরা স্পষ্ট করে কথা বলতে শিখি, যা জানি বা যেটুকু জানি স্পষ্ট করে তা যেন বলি। জানার ভান করে অর্থাত্ মোটামুটি বলে নিজেকে অস্পষ্টতায় যেন না রাখি, যা জানি না, জানি না। শেষ। জানার চেষ্টা করব। ভালো না থাকলে না থাকব। শেষ। ভালো থাকার চেষ্টা করব। এই তো সোজাসুজি রাস্তা। কেন খামোখা মোটামুটির অন্ধগলিতে ঘুরপাক খাওয়া?

No comments

Powered by Blogger.