নড়াইলের তেভাগা নেতা by বিমল বিশ্বাস

জ ১৭ জানুয়ারি ২০১২, কমরেড অমল সেনের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের কিছু উপলব্ধি ও শিক্ষা তুলে ধরার প্রয়াসে আজকের এ লেখা। অমল সেন ১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই নড়াইল সদর উপজেলার আউড়িয়া গ্রামে প্রখ্যাত রায় পরিবারে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।


অগি্নযুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদের নড়াইলের প্রধান ব্যক্তির জন্ম এই রায় পরিবারে। কমরেড অমল সেন নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েন এবং খুলনার দৌলতপুর কলেজে পড়া অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হন। ওই সময়কালের শুরু থেকে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠনে যুক্ত হওয়া এবং আত্মনিয়োগ করার পর থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের জানি দুশমন, কখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, কখনও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও আপস করেননি, লড়েছেন বিরামহীনভাবে। জেল-জুলুম ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে গেলে জনগণের ব্যাপক অংশ কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া জাতীয় মুক্তির এ সংগ্রামে বিজয় অর্জন করা যাবে না, এ উপলব্ধি থেকেই তিনি কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যশোরের এগারখান অঞ্চলে কমরেড রশিক ঘোষের বাড়িতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অমল সেনের কাছে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল, কৃষকদের যে কোনো দাবি-দাওয়াভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে তার নিজ জমিদার পরিবারের বিরুদ্ধেই যাবে। ব্রিটিশ ভারতের ওই সময়কালে একদিকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা এবং বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতপাতের সমস্যা এত প্রকট আকারে বিদ্যমান ছিল যে কায়স্থ জমিদার পরিবারের সন্তানের নিম্নবর্ণের হিন্দু পরিবারে কৃষক পল্লীতে গড়ে ওঠা ছিল তার এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।
কখনও হাটতোলা আন্দোলন, কখনও মৎস্যজীবীদের দাবি-দাওয়াভিত্তিক আন্দোলন, এ ধরনের অসংখ্য খণ্ড খণ্ড আন্দোলন ও লড়াই এবং পরে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে লাগাতার ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। যার ফলে নড়াইলের তেভাগা আন্দোলন কৃষক জনগণের এমন এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই ছিল, যাকে ব্রিটিশ পুলিশ দমন করতে পারেনি। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছিল কৃষক সমিতি এবং কৃষক মহিলাদের ঝটিকা বাহিনী। কৃষকদের এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কমরেড রশিক ঘোষ, কমরেড নূর জালাল, কমরেড বটু দত্ত, কমরেড মোদাচ্ছের মুন্সি, কমরেড আবদুল আজিজ, কমরেড ডাক্তার জহর, কমরেড বামাচরণ গোলদার, কমরেড জ্ঞান সরকার, কমরেড করুণা কিশোর বিশ্বাস, কমরেড রাজেন শিকদার, কমরেড প্রভাত শিকদার, কমরেড নিরোদ লস্কর, কমরেড সরলা সিং, কমরেড অনিমা বিশ্বাস, কমরেড ফুলি বুড়িসহ অসংখ্য নেতা ও সংগঠক গড়ে ওঠেন। নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের বিশেষ নেতা খোঁজাকে কমরেড অমল সেন তাঁর তেভাগা আন্দোলনের সমীক্ষায় বলে গেছেন, 'নড়াইলে তেভাগা আন্দোলনের নায়ক হচ্ছে নড়াইলের কৃষক জনগণ।' এখানে বিশেষ নেতা খোঁজা দুর্বুদ্ধি ছাড়া কিছু নয়। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট হিসেবে কমরেড অমল সেন জনগণ এবং সংগঠকদের ভূমিকাকেই প্রধান হিসেবে দেখতেন। অধুনা এই সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শ্রেণী সংগঠন থাকলে যে তাদের পক্ষে সংগ্রামে যাওয়া সম্ভব হয় না তা কষ্ট করে বোঝার কোনো জিনিস নয়। অথচ আমাদের দেশের যতগুলো দল ততগুলো শ্রেণী গণসংগঠন। বিশেষ করে বামপন্থি ও কমিউনিস্টদের প্রত্যেকের নিজস্ব শ্রেণী ও গণসংগঠন সম্পর্কে কমরেড অমল সেনের মতামত নিম্নে বর্ণিত হলো_
'শ্রেণী সংগঠনের ঐক্যের প্রশ্নে আসল রোগটি রয়েছে অন্যখানে। বুর্জোয়া রাজনীতির ধারায় আচ্ছন্ন থাকার রোগ। শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেণী সংগঠন করার পেছনে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাচ্ছে তা হলো সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবীদের নিজেদের পার্টি ও নেতার অনুগামিত্বে নিয়ে এসে বিপ্লব হাসিল করার দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ আমি দাবি করি, আমার পার্টিই সাচ্চা বিপ্লবী। সুতরাং একত্রে শ্রেণী সংগঠন ও শ্রেণীসংগ্রাম করতে গেলে সংশ্লিষ্ট জনগণ অন্য পার্টি বা নেতার প্রভাবে চলে যাওয়ার আশঙ্কার প্রশ্ন তো আসবেই। কিন্তু সঠিক শ্রমিক শ্রেণীর ধারায় শ্রেণীসংগ্রামের লক্ষ্য হবে সংগ্রামী জনগণের নিজস্ব নেতৃত্ব গড়ে তোলা। নির্ভরশীলতা কাটিয়ে আত্মশক্তিতে তাদের প্রত্যয়ী করে তোলা। এখানে কোন দলের লাভ হবে, কোন দলের লোকসান হবে সে প্রশ্নই আসার জায়গা নেই। লাভ হবে এই যে বিপ্লবী শক্তির ভিত্তি বিকশিত হতে থাকবে। তত্ত্বগত যে বিতর্কই থাক, জনগণের বিকল্প শক্তির বিকাশের কাজকে যারাই প্রাথমিক ভিত্তি মনে করেন, তাদের সকলেরই এতে লাভবান মনে না করার কারণ থাকতে পারে না। শ্রেণী সংগ্রাম ও সংগঠনের বুর্জোয়া ধারার রেশ কাটিয়ে যদি জনগণের বিকল্প শক্তি বিকশিত করার লক্ষ্যে শ্রেণীসংগ্রামের কাজটিকে বিন্যস্ত করা হয়, তাহলে শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেণী সংগঠনের ক্ষেত্রে ঐক্য স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তত্ত্বগত ক্ষেত্রে মতপার্থক্য এবং পার্টি থাকা সত্ত্বেও শ্রেণী সংগঠন ও শ্রেণীসংগ্রামের ঐক্য হওয়ার কোনো বাধা থাকে না।' শ্রেণীসংগ্রাম ও শ্রেণী সংগঠন সম্পর্কে কমরেড অমল সেনের উপলব্ধিকে ধারণ করা এবং তা বাস্তবায়ন করা আজ সময়ের দাবি। কমরেড অমল সেন সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াই ও জনস্বার্থের সংগ্রামে সারাজীবন ধরে বাস্তব কাজের মাধ্যমে যে শিক্ষা তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন, মানবমুক্তির সংগ্রামে বিজয় অর্জন করতে গেলে দেশি-বিদেশি শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.