প্রতিক্রিয়া-টিপাইমুখ বাঁধের ভূমিকম্প ঝুঁকি by মো. আলী আকবর মল্লিক

হিউদ্দিন আহমদ ২৯ ডিসেম্বর ২০১১ প্রথম আলোয় ‘টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করা কেন জরুরি’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘কেউ কেউ আছেন সরাসরি বাঁধের বিরুদ্ধে বলেন না, কিন্তু ভূমিকম্পের জুজুর ভয় দেখান।’ আবার জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান, প্রকৌশলী মো. ইনামুল হক ১৪ জানুয়ারি ২০১১ প্রথম আলোয় ‘টিপাইমুখ ড্যামের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিতর্ক’ নিবন্ধে বলেছেন, ‘ভূমিকম্পের বিষয়টিও বড় নয়।


কারণ, এর সম্ভাবনা ১০০ বছরে একবার মাত্র।’ তাঁদের এই দুটি মন্তব্যের আলোকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি ভূমিকম্প অঞ্চল হচ্ছে (১) আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, (২) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, (৩) জাপান, (৪) মেক্সিকো, (৫) তাইওয়ান ও (৬) তুরস্ক। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পিত স্থানটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছয়টি ভূমিকম্প অঞ্চলের একটিতে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পাঁচটি টেকটনিক সেটিংস যথা (১) ইস্টার্ন হিমালয়ান কলিশন জোন, (২) ইন্ডিয়া-মিয়ানমার সাবডাকশন জোন, (৩) সিনট্যাক্সিস জোন, (৪) শিলং-প্লাটু আসাম-ভ্যালি জোন ও (৫) বেঙ্গল বেসিন এবং ত্রিপুরা-মিজোরাম ফল্ট বেল্ট দ্বারা গঠিত। এই পাঁচটি টেকটনিক সেটিংসে ১৮৬৯ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক শূন্য বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পই ঘটেছে ১৭টি। এর মধ্যে ভূমিকম্পের ইতিহাসে বহুল অলোচিত ১৮৯৭ সালের ১২ জুন রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ১ মাত্রার দি গ্রেট আসাম আর্থকোয়েকটি ঘটেছিল টিপাইমুখ থেকে কমবেশি মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে। এই ভূমিকম্পটি এতই শক্তিশালী ছিল যে এর উৎসস্থল থেকে ৭০০ কিমি ব্যাসার্ধজুড়ে ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ভূমিকম্পটির উৎসস্থল থেকে কমবেশি ২০০ কিমি দূরত্বে আগরতলায় ত্রিপুরার রাজবাড়িটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছিল নাটোরের রাজবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দিনাজপুরের কান্তজিউর মন্দির বা ঢাকার আহসান মঞ্জিল। টিপাইমুখ বাঁধের থেকে ১০০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে গত ১০০ বছরে রিখটার স্কেলে ৫-এর অধিক মাত্রার শতাধিক ভূমিকম্প ঘটেছে। ভারতের সাইজমিক হ্যাজার্ড ম্যাপ দেখতে http://www.bmtpc.org/pdf-misc/eq-india.pdf ঘুরে আসার জন্য যে কারও প্রতি আমন্ত্রণ রইল।
ভূমিকম্প একবার যেখানে ঘটে, সেখানে কোনো রিটার্ন পিরিয়ডে আবারও একই মাত্রায় ঘটতে পারে। তার কারণ, ভূতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য, টেকটনিকের ইতিহাস এবং ভূমিকম্প ঘটা—এই তিনের মধ্যে রক্তের সম্পর্কের মতো একটি সম্পর্ক আছে। এ জন্যই ১৮৯৭ সালের মতো একই মাত্রার একটি ভূমিকম্প ওই একই স্থানে ঘটতে পারে। তা ছাড়া ১৮৬৯ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ঘটা অন্য ১৬টি ভূমিকম্পের যেকোনোটি অজানা কোনো এক রিটার্ন পিরিয়ডে ঘটতে পারে। উল্লেখ করা প্রয়োজন ভারতের পশ্চিমাঞ্চল গুজরাট রাজ্যের ভূজে ২৬ জানুয়ারি ২০০১ রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটে প্রায় ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে কাশ্মীর অঞ্চলে ৪ অক্টোবর ২০০৫ ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটে বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে প্রায় ৭৫ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। টিপাইমুখ বাঁধ অঞ্চল এ দুটো অঞ্চলের চেয়েও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের সাইজমিক জোনিং ম্যাপ এই ঠিকানায়:
www.mapsofindia.com/maps/india/seismiczone.htm
যে অঞ্চলটি এমন একটি ভয়াবহ সাইজমিক হ্যাজার্ড ম্যাপ এবং জোনিং ম্যাপের ইতিহাসসমৃদ্ধ, সে অঞ্চল সম্পর্কে ‘ভূমিকম্পের জুজু’ বলে কঠিন এক বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। উল্লিখিত ১৮৯৭ সালের দি গ্রেট আসাম আর্থকোয়েকটি ঘটেছিল প্রায় ১১৫ বছর আগে। এই ভূমিকম্পটির পুনরাবৃত্তি আজও হয়নি। এ ছাড়া ১৮৬৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আরও যে ১৬টি ৭ দশমিক শূন্য বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল তার বয়স ১৪৩ থেকে ২৪ বছর। এর অনেকগুলোর বয়স ১০০ বছর পার হয়েছে, অনেকগুলো ১০০ বছরের কাছাকাছি, অনেকগুলো অর্ধশত বছর। এর মধ্যে কোন ভূমিকম্পটি ১০০ বছরে একবার ঘটবে? টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশ এক থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ফসল ক্ষতির যে ব্যাখ্যা প্রকৌশলী মো. ইনামুল হক তুলে ধরেছেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু ভূমিকম্প বিষয়ে তাঁর মন্তব্যটি বিভ্রান্তিকর।
টিপাইমুখ বাঁধটির উচ্চতা প্রায় ১৬৩ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৩৯০ মিটার। বাঁধের জলাধারের তলদেশে প্রতি বর্গমিটারে পানির অনুভূমিক চাপ থাকবে প্রায় ১৬০ টন (স্থির অবস্থায়)। ভূমিকম্প ঘটলে পানির এই অনুভূমিক চাপ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। কারণ, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রানুসারে পানির ভর এবং ভূমিকম্পের অনুভূমিক ত্বরণ এই দুটি একে অপরের দ্বারা গুণ হয়ে পানির অনুভূমিক চাপকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে, যার ফলে ভূমিকম্পের মুহূর্তে বাঁধ আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। এ জন্যই একই নকশার দুটি পাশাপাশি ভবনের একটির ছাদে যদি সুইমিংপুল থাকে এবং অপরটিতে না থাকে, তবে সুইমিংপুল থাকা ভবনটি ভূমিকম্পের মুহূর্তে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই কারণে নদীতে ঢেউ না থাকা অবস্থার চেয়ে নদীতে ঢেউ উঠলে নদীর পাড় সহজে ভাঙে। একই কারণে একজন গোয়ালা গ্রামের রাস্তায় ঘাড়ে করে যখন দুধ বহন করে তখন দুধের পাত্রের মধ্যে খেজুরের পাতা ডুবিয়ে রাখে, যাতে করে হাঁটার সময় তরল দুধ ছিটকে না পড়ে।
সংগত কারণে ভাবা স্বাভাবিক যে ভারত টিপাই বাঁধের নকশা ভূমিকম্পের শক্তি আমলে রেখে এমনভাবে করবে যেন সহসা তা ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত না হয়। কারণ, বিধ্বস্ত হলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত আগে ও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাঁধটির পরিকল্পিত অবস্থান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার উজানে হওয়ায় এর অবস্থান বাংলাদেশের শিয়রে। বাঁধ বিধ্বস্ত হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার বিষয়টি ৬ জানুয়ারি ২০১২ প্রথম আলোয় নাসরিন আই খান তাঁর নিবন্ধ ‘জরুরি টিপাইমুখে কীটপতঙ্গের দাঙ্গা’ নিবন্ধে তুলে ধরেছেন। তাই এই বাঁধের নকশা সম্পর্কে বাংলাদেশেরও জানা জরুরি। পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধটি বানালে উভয় দেশের জনগণ সারা জনমের মতো আতঙ্কের মধ্যে থাকবে। ফারাক্কা থেকেও যে অতিরিক্ত উদ্বেগ বাংলাদেশকে তাড়িত করবে, তা হলো বাঁধটি বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল।
ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাmwPe|

No comments

Powered by Blogger.