প্রয়োজন ইংরেজি শিক্ষা : সমস্যা ও সম্ভাবনা by শহিদুল ইসলাম

ক. গত ৯ জানুয়ারি সোমবার দৈনিক সানে প্রকাশিত ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নূরুল ইসলামের ইংরেজি শিরোনামটির বাংলা অনুবাদ আজকের এই লেখার। ড. ইসলামের লেখার এটি প্রথম অংশ। প্রথম অংশ পড়ে আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তা দিয়েই আমি লেখাটি শুরু করছি।


লেখাটিতে যেসব ঐতিহাসিক তথ্যগত ত্রুটি আছে, সে সম্পর্কে পরে আসি। অধ্যাপক ইসলাম জনৈক ভারতীয় পিএইচডি ছাত্রের 'গ্রাহাম গ্রিন' সঠিক উচ্চারণ করতে না পারায় তাঁর কষ্টের কথা লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে যাঁরা ভাষাতত্ত্ববিদ, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন যে প্রতিটি ভাষার তার নিজস্ব উচ্চারণ পদ্ধতি রয়েছে এবং সেই অনুপাতে বা অনুযায়ী জিহ্বা, ঠোঁট, মুখভঙ্গির পেশিমণ্ডলীও এক বিশেষ ভঙ্গিতে গড়ে ওঠে। তাই পৃথিবীর যেকোনো দেশ বা সংস্কৃতির ভাষা-উচ্চারণে আমাদের বা অন্য যেকোনো দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের জিহ্বা, ঠোঁট ও মুখভঙ্গি সেইমতো সাড়া দিতে পারে না। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হলো যেকোনো বিদেশি ভাষা উচ্চারণে বিকৃতি। কাজেই কোনো বিদেশি ভাষা, সেই ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তাদের মতো করে উচ্চারণ করা ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে যাঁরা কাচরুর 'ইনার সার্কেল'-এর যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, তাঁদের পক্ষেও সম্ভব হয় না। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম, যাদের জন্ম ওই সব দেশে, তাদের মুখ-জিহ্বার পেশি ওই সব দেশের উচ্চারণপদ্ধতি অনুসারে গড়ে উঠেছে। ফলে তারা পদে পদে ৩০ থেকে ৪০ বছর ওই সব দেশে বসবাসকারী তাদের মা-বাবার উচ্চারণে ভুল ধরে। তাঁরা যখন দেশে বেড়াতে আসেন, সঙ্গে তাঁদের সন্তানরা থাকলে তাঁদের ইংরেজি উচ্চারণের সঙ্গে সন্তানদের উচ্চারণের আকাশ-পাতাল পার্থক্য লক্ষ করা যায়। আশা করি, এ বিষয়টি অনেকেই লক্ষ করে থাকবেন।
দুই. আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় লিখি। গত বছর (২০১১) আমি ছয় মাস অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে আমার দুই নাতির সঙ্গে কাটিয়ে এলাম। বড়জনের বয়স আট, ছোটজন মাত্র দুই বছরের। আমার মেয়ে কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করে সেখানে যোগদান করেছে। আমার জামাই ওখানকার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউনট্যান্ট। ছয় বছর ধরে তারা সেখানে আছে। তাদের সুবাদে ওখানকার শতাধিক মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। বড়রা সবাই প্রথম প্রজন্মের। কোলের শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ করি। সেই শতাধিক মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই পশ্চিম বাংলার। কেউ ২০ বছর, কেউবা ১০-১৫ বছর ধরে সেখানে আছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের দু-চারজন ছেলেমেয়ে পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছেন। বাংলাদেশের অনেক আগে যাওয়া জনৈক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছেন শিক্ষক হিসেবে। প্রথম প্রজন্ম মা-বাবার ইচ্ছা তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে বাস করুক। বাংলা ভাষাটা যেন একেবারেই ভুলে না যায়। তাই বাড়িতে প্রায় সবাই বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলেন। শিশুদের অনেকেই সুন্দর বাংলা বলে। তবে সে বাংলায় অস্ট্রেলীয় ইংরেজির প্রভাব সুস্পষ্ট। সে ইংরেজি ব্রিটেনের ইংরেজি নয়; অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যের অভিঘাতে সে ভাষা তৈরি হয়েছে। যেমন_আমরা 'য'-কে 'এইচ' বলি, ওরা যে কী বলে তা আমার আট বছরের নাতি কিছুতেই আমাকে দিয়ে উচ্চারণ করাতে পারেনি। এমনকি সে যে পার্থ উচ্চারণ করে, সেটাও আমি উচ্চারণ করতে পারিনি। আমার মেয়েজামাই অনবরত সে দেশের মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করছে ইংরেজি ভাষায়ই; কিন্তু আমার নাতি অনবরত তাদের উচ্চারণে ভুল ধরছে। কাজেই কোনো বিদেশি ভাষা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারার জন্য দুঃখ পাওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়। আরবের আরবি উচ্চারণ আর মিসরের আরবি উচ্চারণ এক নয়। মিসরবাসী আরবদের মতো আরবি ভাষা উচ্চারণ করতে না পারার জন্য আমাদের মতো লজ্জিত হয় কি না জানি না। আয়ারল্যান্ডবাসী ইংল্যান্ডের মতো ইংরেজি ভাষা উচ্চারণ করতে না পারার জন্য আমাদের মতো লজ্জিত হয় কি? পার্থে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীসহ তিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের অনুমতি লাগে এবং স্থানীয় পৌরপিতাকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। তাই প্রতিটি অনুষ্ঠানে বাংলা ও ইংরেজিতে ধারাবর্ণনা করতে হয়। লক্ষ করি, বাংলা ধারাবর্ণনায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বা শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ জানেন এমন কাউকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু ইংরেজি ধারাবর্ণনা করছে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, যারা শুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে। কোনো বিদেশি ভাষা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে গেলে মুখমণ্ডলের পেশির আমূল পরিবর্তন দরকার। একটা বিশেষ বয়সে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ইংরেজি শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারছে না বলে অনেককেই কষ্ট পেতে দেখি।
তিন. ড. নূরুল ইসলাম একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তার ওপর ইংরেজিতে তাঁর এত দখল। প্রতিটি জিনিসের একটি ইতিহাস আছে। ইংরেজি ভাষারও একটি ইতিহাস আছে। তারও বেড়ে ওঠার ইতিহাস আছে। এ প্রসঙ্গে তাঁকে ও তাঁর মতো পণ্ডিতদের আমি রবীন্দ্রনাথের 'স্যাঙ্ন জাতি ও অ্যাংলো-স্যাঙ্ন সাহিত্য' এবং 'নর্মান জাতি ও অ্যাংলো-নর্মান সাহিত্য' প্রবন্ধ দুটি পড়ে দেখার অনুরোধ করব। প্রবন্ধ দুটি পাওয়া যাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর পঞ্চদশ খণ্ড : ক বিবিধে। দীর্ঘ প্রবন্ধ দুটির শেষ স্তবকটি আমি পাঠকের জন্য উদ্ধৃত করব। ইংরেজি আজ আন্তর্জাতিক ভাষা_এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা চলে না। কাজেই যাঁরা ইংরেজি শিখছেন, তাঁরা অনেক সুযোগ-সুবিধা কব্জা করতে পারবেন। যাঁরা পারবেন না, তাঁরা সেই সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। এই সত্যটা সবাই বোঝেন_মেকলের শাসক। রাজা রামমোহন রায়সহ পুনর্জীবনবাদী আন্দোলনের নেতারা বুঝেছিলেন, ড. নূরুল ইসলামের কথায়, সে সময় রক্ষণশীল পশ্চাৎপদ মুসলমানরা বোঝেননি। হিন্দুদের মধ্যেও তখন 'রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ' মানুষের সংখ্যাল্পতা ছিল না। ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা ও বাংলার জেলাগুলোর অধিবাসী প্রায় ১০ হাজার হিন্দু কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে সংস্কৃত ভাষায় একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। সেখানে বেন্টিংকের ৭ মার্চ, ১৮৩৫ সালের সিদ্ধান্ত এই বলে প্রত্যাখ্যান করা হয় যে এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিদ্বেষপূর্ণ, আমাদের পেশা ও ধর্মের প্রতি নাশকতামূলক এবং সরকারের জন্য কুখ্যাতিমূলক। ফার্সির বদলে ইংরেজি প্রচলনের ফলে ডি এল রায়ের বাবা কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় (১৮২০-১৮৮৫) তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন, 'আমরা রাতারাতি অশিক্ষিত হয়ে গেলাম।' ড. ইসলাম কেবল মেকলের কথা লিখেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লর্ড বেন্টিংকের নিয়োগপ্রাপ্ত পাদ্রি উইলিয়াম অ্যাডাম তিন খণ্ড যে শিক্ষা রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে, সেখানে অ্যাডাম এ দেশের শিক্ষা সম্পর্কে কী বলেছিলেন, তার ওপর একটু চোখ রাখতে বলব। মেকলে তাঁর রিপোর্ট অনুমোদন দেওয়ার জন্য বেন্টিংকের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। তা না হলে তিনি জেনারেল কমিটি থেকে পদত্যাগের ভয় দেখিয়েছিলেন। মেকলের পেছনের শক্তি ছিল লন্ডনের বোর্ড অব ডিরেক্টরস। অ্যাডামের মতো আরো অনেক ইংরেজ সিভিলিয়ান মেকলের শিক্ষানীতিকে শুধু ভ্রান্তই বলেননি, ভারতবর্ষের জন্য ক্ষতিকর বলেও মন্তব্য করেছিলেন। যেমন_১৮৭২ সালে যখন উডের ডেসপাস বাস্তবায়িত হচ্ছে, তখন এ. হওসেন ১৮৮২ সালে লেখা �Education in British India� বইতে প্রথমেই লিখছেন, �Education in India under the British Government was first ignored, then violently and successfully opposed, then conducted on a system(মেকলের পদ্ধতি) now universally, admitted to be erroneous and finally placed on its present forting.' মেকলের শিক্ষানীতি ভারতবর্ষের যে কত বড় ক্ষতি সাধন করেছে এবং এখনো করছে, তা ইংরেজ উডের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মেকলের নিম্ন পরিস্রাবণ নীতির ফলে একদিন দেশের সব মানুষের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে_বিগত ১৭৫ বছরেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিন্তু তিনি বাদামি রঙের সাহেব বানাতে চেয়েছিলেন, সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সেটা সফল হয়েছে।
চার. রবীন্দ্রনাথের ওই অনুচ্ছেদটি উদ্ধৃত করে আজকের মতো শেষ করি : 'সাহিত্যপ্রিয় ব্যক্তিরা সেমি-স্যাঙ্ন সাহিত্য চর্চা করিয়া বড়ো আমোদ পাইবেন না। অনুবাদ অনুকরণ ভাবহীন কথার স্রোতেই এই সাহিত্যক্ষেত্র পূর্ণ। তবে ভাষাতত্ত্বপ্রিয় ব্যক্তি ইহা চর্চা করিলে তাহাদের পরিশ্রমের অনেক পুরস্কার পাইবেন। সেমি-স্যাঙ্ন সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে একটা বিশ্বের সাহিত্য নহে, তাহা ইংরেজি সাহিত্যের সূত্রপাত মাত্র। তখন ব্যাকরণ, বানান ও ভাষার কিছুই স্থিরতা ছিল না, একটি পুস্তকেই এককথায় নানা প্রকার বানান আছে, তাহাতে বুঝিবার বড়ো গোল পড়ে। একটি স্থির আদর্শ না থাকাতে সকলেই নিজের ব্যাকরণে, নিজের বানানে, নিজের ভাষায় পুস্তক লিখিত। নর্মান ও স্যাঙ্ন জাতিদ্বয়ের অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তখনকার ভাষা ও সাহিত্য কেমন পরিবর্তিত হইতে লাগিল। অবশেষে কত প্রকার ঘাত-সংঘাতে ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা নির্মিত হইল। ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে নর্মানরা ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে, তখন হইতে যদি ইংরেজি সাহিত্যের নির্মাণকালের আরম্ভ ধরা যায় ও ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে চসার জন্মগ্রহণ করেন, তখন যদি তাহার শেষ ধরা যায়, তবে ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা নির্মিত হইতে প্রায় তিন শত বৎসর লাগিয়াছে বলিতে হইবে।' যখন ইংরেজি ভাষা নির্মিত হচ্ছিল, তখন আরবি ভাষার রাজত্ব। পৃথিবীর দৃষ্টি তখন আরবভূমির দিকে। কেন? কারণ তখন আরবীয় সাম্রাজ্যবাদের ভাষা আরবি। এতে প্রমাণ হয়, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষমতার এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। এ বিষয়ে জানতে পড়ুন এডওয়ার্ড সাঈদ, নোয়াম চমস্কি প্রমুখ।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.