বাঁধ দিয়ে নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে গুলশান লেক by অরূপ দত্ত

খলে-দূষণে ইতিমধ্যেই বিপন্ন রাজধানীর গুলশান লেকের প্রায় পাঁচ বিঘা অংশ মূল লেক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। করাইল বস্তির কাছে গুলশান এভিনিউর পশ্চিম তীরে লেকের বুক চিরে দেওয়া হয়েছে বাঁধ। তার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে নতুন নতুন টিনের ঘর।


গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে লেকের পশ্চিম পাড়ে বস্তিসংলগ্ন কিছু অংশ এবং এর একটু দূরে আরেকটি স্থান ভরাট করে বাঁধ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই স্থানগুলোতে দখলের মাত্রা অনেক বেড়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বশেষ গত শনিবার গুলশান লেক এলাকা ঘুরে অব্যাহত দখলের এই চিত্র দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে লেক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কোনো তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে লেক: লেকপাড় ও মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরিকারীদের বেশির ভাগের দাবি, তাঁরা নিজস্ব জায়গায় ঘর তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, এখানে কারও জমি পৈতৃক, কেউ ক্রয়সূত্রে মালিক। যেসব ঘর উঠেছে, সেগুলোর সামনের অংশ স্পষ্টতই লেক হলেও সেখানকার জমিও নাকি ব্যক্তিমালিকানার। এভাবে চললে ভবিষ্যতে লেকের মাঝ বরাবর অংশও ভরাট হয়ে যাবে বলে এলাকাবাসী আশঙ্কা করছে। এলাকা ঘুরে এ আশঙ্কাকে ভিত্তিহীন মনে হয়নি। করাইল বস্তির কাছে লেকের পাড়ে এবং এখানে-সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে বালু, মাটি ও ইটের খোয়া জড়ো করা হয়েছে। সেগুলোই একটু একটু করে লেকের মধ্যে ফেলে ভরাট করা হবে বলে স্থানীয় লোকজন জানায়।
লেকের পাড়ে নতুন যে স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছে, তার একটির মালিক জনৈকা বিলকিস বেগম। সম্প্রতি বিলকিস এ প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৮৩ সালে এখানে তিনি ৪ শতাংশ জায়গা কেনেন। নিবন্ধনও করা আছে। খাজনাও দেওয়া হয়। তাঁর দাবি, এখানে লেকের প্রশস্ততা ৩০ ফুট, এর বাইরের জায়গা লেকের নয়। তবে রাজউক সূত্র বলছে, এ কথা সত্যি নয়। লেকের প্রস্থ কোথাও কোথাও ১০০ ফুটও রয়েছে।
পাশেই প্রায় আধা বিঘা জায়গার মালিক দাবিদার টিঅ্যান্ডটির সাবেক গাড়িচালক কবির উদ্দিন মোল্লা। কবির প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার আগে তিনি শ্বশুরবাড়ির পক্ষের কাছ থেকে ওই জমি কেনেন। তাঁর দাবি, জায়গাটি তাঁর শাশুড়ির পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। বিলকিস বেগম ও কবির মোল্লার দখলে থাকা জমির মধ্যে লেকতীরে নির্মিত ঘর ছাড়াও পানির মধ্যে টংঘর রয়েছে।
এ ধরনের আরও অনেকে রয়েছেন, যাঁদের কারও কারও দাবি লেকের মধ্যে তাঁদের এক বিঘারও বেশি জায়গা রয়েছে। জমির মালিক দাবিদার বলে অনেকেই বলেন, হাজি শাহাবুদ্দিন (মৃত) নামের এক ব্যক্তি স্বাধীনতার আগে-পরে লেকের প্রচুর জায়গা বিক্রি করেছিলেন। যাঁরা ঘর তুলছেন, তাঁদের বেশির ভাগই হাজি শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে জায়গা কিনেছেন বলে দাবি করেন। এলাকার কেউ কেউ এ প্রতিবেদককে বলেন, অনেকে জায়গা দখলও করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, তিনি পরিচিত এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে এখানে দৃশ্যত লেক ভরাট করে তৈরি জায়গা ভাড়া নিয়েছেন। তিনি নিজ খরচে টিনের ঘর তুলে বসবাস করছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, জায়গাটি সরকারি হলে কর্তৃপক্ষ যখনই বলবে, উঠে যাবেন। তবে এখানে অনেক দখলদার রয়েছেন, যাঁরা প্রভাবশালী।
তদারকির অভাব: গুলশান লেকের ১০০ একর আয়তনের মধ্যে ৪০ একরই কোনো কর্তৃপক্ষ দেখাশোনা করে না। তাই করাইল বস্তি ও সুইপার কলোনির আশপাশের অংশটি অনেকটাই নজরদারির বাইরে রয়ে গেছে বলে রাজউকসহ সরকারি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন।
রাজউকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, লেকের কিছু অংশ সরাসরি তাঁদের তত্ত্বাবধানে না থাকায় তদারকির সমস্যা হয়। এ ছাড়া কিছু দখলদার তাঁদের দখল করা জায়গার বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন।
তবে আদালতের স্থগিতাদেশ নেই এমন অনেক অবৈধ দখল করা জমিতেও বাড়িঘর তোলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে মাটি, বালু বা রাবিশ ফেলে লেকপাড়ের প্লটের সীমানা বাড়িয়ে লেকের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. মহিবুল হক গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসন লেক রক্ষার পক্ষে। লেকটি উন্নয়নে বড় প্রকল্প হলে অসাধু ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য কমে যেতে পারে। নিয়মিত তদারকি হলে এমনভাবে দখল হতে পারে না।’
জেলা প্রশাসক বলেন, লেক এলাকায় কোনো জায়গা এখনো অধিগ্রহণের বাইরে থাকলে কেন্দ্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ কমিটি অনুমোদন দিলে জেলা প্রশাসন তা অধিগ্রহণ করতে পারে। আর লেক দখলের বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে জেলা প্রশাসন তাও উদ্ধার করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.