সরকারি ধান-চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অনিশ্চিতঃ খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশজুড়ে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরই বলে দিচ্ছে, এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন কষ্টকর হবে। এর জন্য ধান-চালের বাজার দরের চেয়ে নির্ধারিত দর কম এবং উত্পাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়াই দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে বাজারে ধান-চালসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে আগে থেকেই ধান-চালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এ সবকিছুই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গতকালের আমার দেশ জানিয়েছে, উত্তরাঞ্চলে আমন ধান-চাল সংগ্রহে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আমনের ভরা মৌসুমে ধান-চালের মূল্যবৃদ্ধি শুধু অস্বাভাবিক নয়, আশঙ্কাজনকই বটে। সরকারি হিসাবেই বাজারে চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। মোটা চালের দাম বেড়েছে তুলনামূলক বেশি, ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সরকার ঘোষিত দরের চেয়ে বাজারে দর বেশি হওয়ায় ধান-চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এবার সরকারিভাবে দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ১৪ টাকা অর্থাত্ মণপ্রতি ৫শ’ টাকার কিছু বেশি আর চাল কেজিপ্রতি ২২ টাকা, মণপ্রতি প্রায় ৮শ’ টাকা। অথচ বাজারে এখন প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা এবং মোটা চালের দাম মণপ্রতি কমবেশি এক হাজার টাকা। এ কারণে সরকারি গুদামে আসছে না ধান-চাল। শুধু উত্তরাঞ্চলেই নয়, দক্ষিণাঞ্চলেও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছে। বাজার দর থেকে কম দাম ও সংগ্রহের নীতিমালার কারণে কৃষক সরকারি গুদামে ধান-চাল বিক্রিতে মোটেই আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে গত মৌসুমের মতো এবারও সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এজন্য বাজার দরের সঙ্গে সরকারি দরের অসঙ্গতির পাশাপাশি ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়াও দায়ী। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ধানের ফলনও কম হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন জেলায় সেচ ও বীজ সঙ্কটের কারণেও উত্পাদন ব্যাহত হয়েছে। রোপণের শুরুতে বিঘাপ্রতি গড়ে ১৬ থেকে ১৮ মণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উত্পাদিত হয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ মণ ধান। সরকারি কৃষি কর্মকর্তারাই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ শতাংশ ধান কম উত্পাদনের কথা স্বীকার করেছেন। ফলে রাজশাহী অঞ্চলেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ১১০ মেট্রিক টন। দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও একই ধরনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এ সবই আমাদের কৃষির নড়বড়ে অবস্থা প্রমাণ করে। কৃষক ধারদেনা করে সর্বস্ব বিনিয়োগ করেও আশানুরূপ উত্পাদন না হওয়ায় মার খায়। মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ গ্রহণ করে মজুতদার ও মিল মালিকরা। সরকারি সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় সৃষ্ট ঘাটতি মোকাবিলায় চাল আমদানি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। দুর্ভাবনার বিষয় যে, সেক্ষেত্রেও বিরূপ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রধান রফতানিকারক দেশগুলো নিজেরাই এখন চাল আমদানি করছে। ফলে সেখানেও দাম চড়ে গেছে। এ অবস্থায় বাজারে ধানচালের মূল্যবৃদ্ধির গতি ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এখনই ধান-চালসহ খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা সবার জন্য সতর্ক সঙ্কেত দেয়। এই মূল্যবৃদ্ধি সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাবে না, সেটা কেউ বলতে পারে না। এক্ষেত্রে রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। রোববার মাসিক অপরাধ সভায় ডাকাতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, অভাবের তাড়নায় নগরীতে ডাকাতি বেড়েছে। আগের মাসের তুলনায় শুধু ডাকাতি ও দস্যুতা বৃদ্ধিই নয়—ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, গাড়ি চুরি, মলম পার্টির দৌরাত্ম্য সবই বেড়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন। সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
এ অবস্থায় খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মুখের কথায় সন্তুষ্ট না থেকে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার ওপর ধান উত্পাদনে ঘাটতি ও সরকারি ধান-চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকেই প্রকট করে তোলে। তাই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সবাইকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে; এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

No comments

Powered by Blogger.