বহে কাল নিরবধি-নতুন বছরে সম্ভাবনাহীন সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা by এম আবদুল হাফিজ

০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট মহাসমারোহে যখন ক্ষমতার দুর্গে প্রবেশ করে, তখন এ দেশের রাজনীতির অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা প্রমাদ গুনে থাকবেন। এমন একটি প্রতিক্রিয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। বিরোধী দলের ভূমিকায় আওয়ামী লীগ তার হৃত অবস্থানে ফিরতে চমৎকার পারফর্ম করে; কিন্তু ঈর্ষণীয় শক্তি সহকারে তা ক্ষমতায় এলেও কেমন যেন ঘোঁট পাকিয়ে ফেলে, যা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বছরগুলোতে আমরা এন্তার দেখেছি।


বঙ্গবন্ধু নিঃসন্দেহে খুব বড় মাপের নেতা ছিলেন এবং প্রতিকূল পরিবেশে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি স্ট্যাটাস কো-র পক্ষপাতী ছিল এবং কোনোক্রমেই আরেকটি সহিংস ও রক্তাক্ত সংঘাতের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তা যতই যৌক্তিক হোক না কেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সেটিই ছিল বিরাট প্রতিকূলতা।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আফ্রিকার নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রাকে ঘিরেও বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ চলছিল এবং নাইজেরিয়ার খ্রিস্টান অধ্যুষিত বঞ্চনার শিকার এই প্রদেশটির অনুকূলে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনেক যৌক্তিক কারণ ছিল। তবু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনীহায় বায়াফ্রা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারেনি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কৌশলে এবং সঠিক রাজনীতির বদৌলতে বাংলাদেশ তা পেরেছিল। সেই বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনা একইভাবে আশানুরূপ হয়নি। তা যে হতেই হবে, এমন কোনো কথাও নেই। আফটার অল, তিনি অতিমানব ছিলেন না, বরং মানবিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দোষে-গুণের মানুষ হয়েও তিনি একটি জাতি ও রাষ্ট্রের স্থপতি হয়েছিলেন। এ কি কোনো মামুলি কথা!
আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ১৯৯৬ সালে আবার ক্ষমতায় এসেছিল সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায়, তাও আবার তৃতীয় একটি দলের সহায়তা নিয়ে। আওয়ামী লীগের জন্য ওই ক্ষমতা লাভ আওয়ামীরা চাইলে তাঁদের অনেক অনুকূলে লাগাতে পারত। তত দিনে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পদ্মা-যমুনা-মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। পৃথিবীটাও বদলে গেছে অনেক। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক বিরূপ বাস্তবতা আমরা তত দিনে প্রত্যক্ষ করেছি। একটি শুদ্ধি অভিযানের ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগ আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভারতের কংগ্রেসের মতো সুদীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে পারত। তার জন্য অবশ্য দরকার একটি বিশুদ্ধ সংগঠন এবং পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যাসংকুল দেশকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পেঁৗছানোর জন্য একটি বিশ্ব দর্শন (ডড়ৎষফ ারব)ি। আওয়ামীদের এসবের কোনো বালাই ছিল না। তারা বিশ্বাস করত পেছনে তাকানো লাঠিয়ালের রাজনীতিতে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের জন্য এসেছিল আরেকটি সুবর্ণ সুযোগ! কী নির্মম হেলায় তা আবার নষ্ট হতে চলেছে। আল্লাহ মালুম, কে বা কোন মহল তাদের কতগুলো তোতাপাখির বুলি শিখিয়ে দিয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ, অমুক না তমুক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের একটি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া বা কানেকটিভিটি ইত্যাদি। দেশে যথাযথ অবকাঠামো নেই, অর্থনীতি নড়বড়ে, বড় কষ্টে আছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত মানুষ, বিনিয়োগবিহীন অতি স্ফীত এক মুদ্রাস্ফীতির দেশে শুধু প্রতিশ্রুতি এবং অমুক সালে আমরা এটা বা ওটা অর্জন করব_এমন সব বুলি আওড়িয়েই কি আমরা লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারব বা আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতার দুর্গে প্রবেশ করবে? বিরোধী দল বিএনপির কথা না হয় বাদই দিলাম, যদিও তাদের শতকরা ৪০ ভাগ দলের সমর্থন আছে, তাদের নেত্রী ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ের মধ্যেও দেশরত্নের মতোই তাঁর সব আসনে জয়ী হয়েছেন ও তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অটুট রাখতে পেরেছেন এবং সব উপনির্বাচনে ও দেশের সিটি করপোরেশনগুলোতে দলের সম্ভাবনাকে এ পর্যন্ত উজ্জ্বলই রেখেছেন_দেশের সংবাদপত্রগুলো এবং আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে তাদের মূল্যায়নগুলো কী বলে? নেহাত আওয়ামী লীগের কতিপয় মুখচেনা 'গুণমুগ্ধ' ছাড়া আপামর সাংবাদিক সম্প্রদায় সারা দেশ ঘুরে যে তথ্য তুলে আনে, তার মধ্যে ইতিবাচক কি কিছু আছে?
হ্যাঁ, বিদ্যুৎ সরবরাহে এই শীতের মৌসুমে কিছু স্থিতিশীলতা অন্তত আমি যেখানে থাকি (ডিওএইচএস নামের অভিজাত এলাকায়) সেখানে আছে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ আমরা কিসের বিনিময়ে পাই? এই অজুহাতে সেই অজুহাতে বিগত বছরেই নাকি বিদ্যুতের দাম পাঁচ-পাঁচবার বেড়েছে এবং আরো যে বাড়তে পারে, সেই সম্ভাবনার ডেমাক্লিসের তরবারি সর্বক্ষণ আমাদের ঘাড়ের ওপর ঝুলছে। এমন বিদ্যুৎ সরবরাহকেও কী আওয়ামীরা সাফল্য বলবেন! টিভি চ্যানেলে জনদুর্ভোগের যে প্রোগ্রামগুলো প্রদর্শিত হয়, তাও কি মিথ্যা?
কালেভদ্রে যখন শহরে বের হই, অনেক কাজের তৎপরতা গোচরীভূত হয়, দেখি যে উড়াল সড়কের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। জনৈক বন্ধুকে এসব তৎপরতার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তার মত আবার অন্য রকম। তার কথায় কাজ না হলে আওয়ামী আনুকূল্যপুষ্ট ঠিকাদাররা তাদের বখরা কোত্থেকে পাবে? তাই কাজ দ্রুত হতেই পারে এবং তা আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হতে হবে। অতঃপর যখন তারা বিদায় (যদি আদৌও নেয়) নেবে, তখন আমাদের রেখে যাওয়া হবে আরেক প্রতারকের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির মধ্যে।
আমাদের দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী আবার দেশ নায়কত্বের পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন, যা তাঁর ৩৫ জন সফরসঙ্গী ত্রিপুরায় অবলোকন করবেন। অবাক হয়ে ভাবি_আর কত পিএইচডি বা ডিলিটের প্রয়োজন? ইতিমধ্যেই এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমকক্ষদের ছাড়িয়ে গেছেন। জানি না বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কী হলো। কিন্তু এদিকে তো বর্তমান শাহজালাল বিমানবন্দরটি ক্লাস ওয়ান বিমানবন্দরের স্বীকৃতি পাচ্ছে না, যা না পেলে বাংলাদেশের পতাকাবাহী বিমান বর্তমানে স্থগিত ঢাকা-নিউ ইয়র্ক রুটে উড়তে পারবে না। কেউ কি কখনো শুনেছে যে কোনো প্রকল্পের জন্য দাতা সংস্থারা দুর্নীতির সম্ভাবনায় তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবু নাকি পদ্মা সেতু নির্মাণ আটকে থাকবে না। আমরা যতদূর জানি, দেশি বা বিদেশি কোনো প্রাইভেট সংস্থা এই প্রকল্পে অর্থ লগি্ন করার প্রস্তাব নিয়ে আসেনি এখনো। তাহলে আওয়ামীরা ২০১৪ সালে পরবর্তী নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোট চাইবে কোন মুখে? এসবের পরোয়া করে না আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের প্রাক্কালে না হয় আবার কান্নাকাটি বা নতুন স্বপ্ন পূরণের কিরা-কসম করা যাবে। বঙ্গবন্ধু তাদের সবচেয়ে বিপণনযোগ্য ব্র্যান্ড। ভোটের ক্লেদাক্ত পরিবেশে তাঁর নাম টেনে আনতেও বাধবে না আওয়ামীদের।
আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদে ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর পরই কালের কণ্ঠে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম_আওয়ামী লীগ ও বিএনপি: মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ভাবিনি যে সে নিবন্ধে আমার আশঙ্কা এত সত্বর সত্যে পরিণত হবে। আগামী নির্বাচনেও দল দুটির যে-ই ক্ষমতাসীন হোক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সুখবর নেই। আমরা শুধু মহার্ঘতা, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা এবং দারিদ্র্য-বৈষম্যের অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকব। এটাই আমাদের নিয়তি!
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস

No comments

Powered by Blogger.