'এক পলকের একটু দেখা/ আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?’... by মাহবুব তালুকদার

গুরুদেব তাহার আসনে বসিয়া যোগধ্যান করিতেছিলেন। শিষ্য তাহার পদপ্রান্তে উপবিষ্ট ছিল। গুরুদেবের মুখমণ্ডল হইতে বিচ্ছুরিত আভা দেখিয়া শিষ্য ভাবিল পৃথিবীর যাবতীয় রহস্যই প্রভুর অধিগত হইয়াছে। সে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলিয়া এই ঐশ্বরিক ঘটনা অবলোকন করিতে থাকিল। এক সময়ে গুরুদেব নয়নযুগল উন্মোচিত করিয়া কহিলেন, বত্স! অবধান করো।
যথা আজ্ঞা প্রভু। শিষ্য বলিল, আমি দৃষ্টি ও কর্ণ উন্মুক্ত করিয়া আপনার বাণীর প্রতীক্ষা করিতেছি।
মাহেন্দ্রক্ষণ বলিতে তুমি কী বোঝ?
উহাকে শুভক্ষণ বলা হয়।
সাধু! সাধু! গুরুদেব জানাইলেন, ইহা কেবল শুভক্ষণ নহে, শুভ যোগও বটে। আমাদের জাতীয় জীবনে কস্ফচিত্ ইহার উদ্ভব ঘটিয়া থাকে।
মহাত্মন! এইরূপ কোনো শুভক্ষণ কি সম্প্রতি ঘটিয়াছে?
হ্যাঁ। গত কিছুদিনের মধ্যে আমরা দু’বার মাহেন্দ্রক্ষণের স্পর্শ পাইয়াছি। একবার রোজার সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর ইফতারির আয়োজনে এবং অন্যবার সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। এই দুইয়েরই ঘটনাস্থল ছিল সেনাকুঞ্জ।
প্রভু! ইহার কি কোনো মাজেজা আছে?
অবশ্যই আছে। তবে তাহা বর্ণনার আগে তুমি এই গানটি শুনিয়া লও।
গুরুদেব অতঃপর তাহার ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া একটি গান বাজাইলেন। গানটি হইল ‘এক পলকের একটু দেখা আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?’ এই গান শিষ্য অনেকবার শুনিয়াছে।
গান শেষ হইলে গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন, কী বুঝিলে?
ইহা একটি পুরাতন আধুনিক বাংলা গান। আমি বহুবার ইহা শুনিয়াছি।
শুনিয়াছ, কিন্তু ইহার মহিমা বুঝিতে পারো নাই।
স্যার! আমার অজ্ঞতা মার্জনা করিবেন। ইহা তো একটি সাধারণ গান। এই গানের মহিমা কী?
গুরুদেব মৃদু হাস্যভরে বলিলেন, ইহা কোনো সাধারণ গান নহে, একটি অসাধারণ গান। গানটির প্রথম দুই চরণে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। জনগণের কাকুতি-মিনতিও পরস্ফুিট হইয়াছে এই গানের মধ্যে।
হুজুর! সত্যি আমি ইহার মাজেজা বুঝিতে পারিতেছি না।
এই জন্য তোমার বোধের অপরিপকস্ফতা দায়ী, অন্য কিছু নহে। তবে হতাশ হওয়ার কারণ নাই। বুদ্ধি পরিপকস্ফ থাকিলে বোধও এক সময়ে পরিপকস্ফ হইবে।
মহামহিম! আপনার অনুগ্রহ পাইলে নিশ্চয় আমি সাফল্য লাভ করিব।
শিষ্যের আত্মনিবেদনের ভাষা শুনিয়া গুরুদেবের পরম সন্তোষ হইল। তিনি বলিলেন, আমাদের দুই প্রধান নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একপলকের দেখা হওয়াই এই গানের উপজীব্য। সমগ্রজাতির প্রত্যাশা কিশোর কুমারের এই গানের মধ্য দিয়া পরিব্যক্ত হইয়াছে।
তাহাদের উভয়ের সাক্ষাত্ হওয়া কি কোনো অলৌকিক ঘটনা?
অবশ্যই। গুরুদেব ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া সম্প্রতি সেনাকুঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের দৃশ্যটি স্ক্রিনের উপরে তুলিয়া আনিলেন। বলিলেন, ইহা এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এই দৃশ্যটি কিরূপ হইবে, মিডিয়ায় তাহা লইয়া কল্পনা-পরিকল্পনার অন্ত ছিল না। পরদিন অধিকাংশ পত্রিকায় তাহাদের সাক্ষাতের ছবি ও ঘটনাই ছিল ব্যানার আইটেম।
শিষ্য টেলিভিশনে দুই নেত্রীর সাক্ষাত্কারের দৃশ্যটি দেখিয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর পরনে ছিল ক্রিম রংয়ের শাড়ি এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর পরনে ছিল ফিরোজা রংয়ের শাড়ি। তাহাদের উভয়কেই অত্যন্ত গ্লামারাস দেখাইতেছিল। অনুষ্ঠানে উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল। তবে দুই নেত্রীর কথোপকথনের দৃশ্যটি খুব একটা বোঝা যায় নাই। প্রকারান্তরে স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রী দীর্ঘসময় পাশাপাশি সোফায় বসিয়া আলোচনা করেন।
শিষ্য কহিল, মহাত্মন! পত্রিকায় দেখিয়াছি উভয় নেত্রীর মধ্যে কথা হইয়াছে মাত্র এক মিনিট। ইহা তো খুবই কম সময়।
গুরুদেব মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, তোমার কথাতেই কিশোর কুমারের ওই গানটির অনুভূতিই ব্যক্ত হইয়াছে। তবে তাহাদের মধ্যে এক মিনিট কথা হইয়া থাকিলে আমি উহাকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে দেখি।
কেন প্রভু?
কারণ গত ১০ সেপ্টেম্বর ইফতার অনুষ্ঠানে দুই নেত্রীর মধ্যে কথা হইয়াছিল বাইশ সেকেন্ড। এইবার সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণেরও বেশি।
কিন্তু তাহারা সম্ভবত সৌজন্যমূলক আলাপের মধ্যেই নিজেদের সীমিত রাখিয়াছিলেন।
সম্ভবত উহা ছিল সৌজন্য আলাপেরও অধিক কিছু। কারণ ওই দিন একটি টিভি চ্যানেলের টক-শোয়ে দৈনিক পত্রিকার একজন সম্পাদক জানাইয়াছেন, প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীর নিকট তাহার পায়ের সমস্যার বিষয়ে জানিতে চাহিয়াছেন। ইহা ঠিক হইলে বলিতে হয় যে, ইহার তাত্পর্য কম নহে। গুরুদেব বলিলেন।কিন্তু প্রভু! এই সামান্য বিষয়টিকে এত অসামান্য করিয়া দেখা হইতেছে কেন?
তোমার নিকট ইহা সামান্য বিষয় বলিয়া বোধ হইলেও দেশের জনগণ ইহাকে অসামান্য বিষয় বলিয়া মনে করে।
ইহার কারণ কী?
কারণ বলিতে গেলে এক কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নহে। গুরুদেব কহিলেন, আমরা এক অর্থে একটি হতভাগ্য জাতি। আমাদের প্রধান দুই দলের দুই প্রয়াত নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হইয়াছেন। তাহাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। সাংবিধানিক গণতন্ত্র বলিতে যাহাই বোঝাক না কেন, দেশের মানুষের এই দুই নেত্রীর প্রতি আস্থা অপরিসীম। ভবিষ্যতেও যে তাহাদের দুই পরিবার দ্বারাই এই দেশ শাসিত হইবে, তাহা আর বলিয়া দিতে হয় না।
গুরুদেব আরও বলিলেন, দুই নেত্রীর রাজনৈতিক শক্তির অগ্নিপরীক্ষা হইয়াছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ‘মাইনাস টু’ থিউরি দ্বারা তাহাদিগকে রাজনীতি হইতে নির্বাসিত করার চেষ্টা হইয়াছিল। তাহাদিগকে অন্তরীণও রাখা হয়। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করিয়া দুই নেত্রী পুনরায় জনগণের নিকট ফিরিয়া আসেন। তাহাদের উপর তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের আস্থাই তাহাদের অপার শক্তি। শুধু নেত্রীদের প্রতি নহে, তাহাদের পরিবারের প্রতিও মানুষের নির্ভরশীলতায় বিস্মিত হইতে হয়।
মহাত্মন! এই পরিবারতন্ত্র সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া কয়েক দিন পূর্বে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বীরউত্তম কাদের সিদ্দিকী ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন, ‘কোনো রিকশাওয়ালার ছেলে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেও সে কখনও ক্ষমতায় যেতে পারবে না। ক্ষমতার স্বাদ পেতে হলে এদেশে হাসিনা-খালেদার পেটের সন্তান হয়ে পুনর্জন্ম নিতে হবে। তবে আমরা মুসলমান হওয়ায় এটাও বিশ্বাস করতে পারি না। গোটা জাতি আজ দু’ তিনটা পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।’ (দৈনিক মানবজমিন, ১২ নভেম্বর ২০০৯)। শিষ্য বিষয়টি বিস্তারিত জানাইল। বাছা! উত্তরাধিকারের রাজনীতি কেবল আমাদের দেশে প্রচলিত নহে। এই উপমহাদেশে, এমনকি এশিয়ার এতদঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা চালু রহিয়াছে। গণতন্ত্রের আবরণে কেন পরিবারতন্ত্রের রাজনৈতিক ধারা বহমান থাকে, তাহা লইয়া গবেষণা চলিতে পারে। কিন্তু ইহাই বাস্তবতা। তবে আমাদের আলোচনা এই বিষয়ে নহে।
আপনি দুই নেত্রী সম্পর্কে কথা বলিতেছিলেন।
হ্যাঁ। আমাদের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান একেবারে পরস্পরের বিপরীতে। আদর্শ হিসেবে দুই বড় দলের ব্যবধান তত বেশি না হইলেও মনস্তাত্মিক ব্যবধান আকাশ ও পাতালতুল্য। বিভাজনের রাজনীতিই বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশের অনিবার্য পরিণতি।
এই বিভাজনকে কেন সকলেই মানিয়া লইতেছে?
ইহার বহুমাত্রিক কারণ থাকিলেও প্রধানত দুই প্রয়াত নেতার চেতনা ধারণ করিয়া দুইটি রাজনৈতিক দলের দুইটি ভিন্নস্রোত বহিয়া চলিয়াছে। দুই দলের পারস্পরিক অনাস্থার ক্ষেত্র এত বিস্তৃত যে দেশ পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতার অবকাশ থাকে না।
কেন এহেন অবস্থা প্রভু?
আমাদের জাতিসত্তার বিকাশেই কোনো একক অভিব্যক্তি নাই।
বিষয়টি আমার বোধগম্য হইতেছে না।
আমি তোমাকে কিছুটা উদাহরণ সহকারে বুঝাইতেছি। আমাদের দেশ বা জাতির মূলমন্ত্রই দ্বিখণ্ডিত। এক দল ‘জয় বাংলা’ ও অপর দল ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এ বিশ্বাসী। ইহাই বিভাজনের বিষবৃক্ষকে মহীরূহে পরিণত করিয়াছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এইরূপ আত্মঘাতী বিভাজন চাহে না। গুরুদেব উদ্দীপ্তকণ্ঠে কহিলেন, দেশের মানুষ জাতিসত্তা ও মৌলিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা ও ঐকমত্য দেখিতে চায়। বিশেষভাবে দুইটি বড় দলের মধ্যে তাহারা অন্তত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অবকাশ আশা করে।
প্রভু! তাই কি দুই নেত্রী কোথাও মুখোমুখি সাক্ষাতের সুযোগ ঘটিলে উহা পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়? টেলিভিশনের টক-শোতে তাহাদের সাক্ষাতের বিষয়বস্তু আলোচনায় গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত হয়?
তুমি বিষয়টি এইবার যথার্থ অনুধাবন করিতে পারিতেছো।
শিষ্য কহিল, এতক্ষণে বুঝিলাম, ‘এক পলকের একটু দেখা আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি!’ গানটির মাহাত্ম্য কী। আমিও মনে করি আমাদের দুই জনপ্রিয় নেত্রী বাইশ সেকেন্ড বা এক মিনিট নহে, অধিকতর সময়ের জন্য এক সঙ্গে বসিয়া জাতীয় বিষয়াদি লইয়া আলাপ-আলোচনা করিতে পারেন। শিষ্য ম্লানকণ্ঠে জিজ্ঞাসিল, তাহা কি সত্যি সম্ভব প্রভু?
কেন সম্ভব হইবে না?
গুরুদেব মৃদু হাসিয়া কহিলেন, বাইশ সেকেন্ড হইতে পরবর্তীকালে এক মিনিট এবং এক মিনিট হইতে আগামীতে তিন মিনিট—এইভাবে কথাবার্তা হইলে দেশ ও জাতির জন্য তাহা অত্যন্ত ইতিবাচক হইবে।
অতঃপর গুরুদেব ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া আবার সেই গানটি বাজাইয়া দিলেন—‘এক পলকের একটু দেখা আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?’...
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল : mahbub_talukdar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.