গোলাম আযম কারাগারে

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় স্বাধীনতার ৪০ বছর পর কারাগারে পাঠানো হলো জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল বুধবার জামিনের আবেদন খারিজ করে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গোলাম আযমকে প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নেওয়া হয়।


সেখান থেকে বিকেল তিনটা ৫০ মিনিটে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রাত আটটার দিকে তাঁকে হাসপাতালের প্রিজন সেলে নেওয়া হয়।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ৯ জানুয়ারি এই মামলার অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় এবং গতকাল তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জামিনের আবেদন খারিজের প্রতিক্রিয়ায় গোলাম আযমের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, এই আদেশ সঠিক হয়নি। তবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ বলেন, এই আদেশ আইনসিদ্ধ।
সকাল নয়টা ৫০ মিনিটে আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের গাড়িতে ছেলে আমান আল-আজমীকে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে আসেন গোলাম আযম। প্রায় ১৫ মিনিট পর তাঁকে হুইলচেয়ারে করে দোতলায় এজলাসকক্ষে নেওয়া হয়। তাঁর পরনে ছিল ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা, মাথায় জিন্নাহ টুপি। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর আগে কাঠগড়ায় বসে তিনি আইনজীবী ও বিভিন্নজনের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। বিচারকেরা এজলাসে এলে তিনি তাঁদের সালাম দেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও এ কে এম জহির আহমেদ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে।
শুরুতে জামিনের আবেদনের শুনানিতে গোলাম আযমের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ৯ জানুয়ারির আদেশ অনুসারে গোলাম আযম হাজির হয়েছেন। তাঁর বয়স ৮৯ বছর দুই মাসেরও বেশি। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি কারও সাহায্য ছাড়া ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তিনি বলেন, এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৮০ বছর বয়সী আবদুল আলীমকে গ্রেপ্তার করা হলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাঁকে জামিন দেওয়া হয়। গোলাম আযমের বয়স আলীমের চেয়ে নয় বছর বেশি। যেসব শর্ত দিয়ে ও বিষয়গুলো বিবেচনা করে আলীমকে জামিন দেওয়া হয়েছিল, একই শর্ত দিয়ে ও বিবেচনায় তিনি গোলাম আযমের জামিনের আরজি জানান।
জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ বলেন, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পর্কিত। তিনি তৎকালীন জামায়াতের আমির ছিলেন। তিনি রাজাকার, ইসলামী ছাত্র সংঘ, আলবদর, আলশামসের নেতা ছিলেন। তিনি দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মূল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী।
গোলাম আরিফ এ সময় মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ৯০-এর বেশি বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কারাগারে থেকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় এই উদাহরণ আছে।
এরপর ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা করে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জামিনের আবেদন খারিজ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আদেশ: ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়, এর আগে ট্রাইব্যুনাল শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে আবদুল আলীমকে জামিন দিয়েছেন। আলীমের বিষয়ে আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি অসুস্থ এবং তাঁর পক্ষে হুইলচেয়ার ছাড়া চলাচল করা সম্ভব নয়। তাঁর বিরুদ্ধে এখনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়নি। গোলাম আযমও বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন এবং স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তার পরও তাঁর চলাফেরার জন্য হুইলচেয়ার প্রয়োজন হয় না। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের পর ইতিমধ্যে তা আমলে নেওয়া হয়েছে, বিচারপ্রক্রিয়াও শুরু হতে যাচ্ছে। এই মামলা আলীমের বিরুদ্ধে মামলা থেকে ভিন্ন।
আদেশে আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। সম্ভ্রমহারা হয়েছেন চার লাখ নারী আর জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রায় এক কোটি মানুষ। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার সঙ্গে এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, যেসব অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ প্রণীত হয়েছে। গোটা জাতি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চায়। কে দোষী বা নির্দোষ, সেটা জানা যাবে বিচারের পর। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল এখন গোলাম আযমকে জামিন দিতে আগ্রহী নন। তাঁকে হেফাজতে নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হোক।
আদেশে ট্রাইব্যুনাল ১৫ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন। আসামিপক্ষকে সরবরাহের জন্য মামলার কাগজপত্র রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে বৃহস্পতিবারের (আজ) মধ্যে জমা দেওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেন। আসামিপক্ষ ১৫ জানুয়ারি ওই কাগজপত্র সংগ্রহ করবে।
ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শাহিনুর ইসলাম পরে সাংবাদিকদের বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দিয়েছেন। আদেশ অনুসারে গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর জন্য রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হেফাজত পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে শুনানির দিন তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হবে।
আদেশের পর গোলাম আযমের হাসিখুশি মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনাল থেকে তাঁকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান কারাগারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আইনজীবীরা একটি বড় সুটকেস তাঁর সঙ্গে দেন। ট্রাইব্যুনালের দক্ষিণ ফটক দিয়ে প্রিজন ভ্যানটি বের হওয়ার সময় সামনের সড়কে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শতাধিক মানুষ ‘গোলাম আযমের ফাঁসি চাই’ স্লোগান দেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রিজন ভ্যানটি কারাগারে পৌঁছায়।
ট্রাইব্যুনালের পরিবেশ: গোলাম আযমকে হাজির করার দিন পুনর্নির্ধারিত থাকায় পুরাতন ও নতুন হাইকোর্ট ভবনসহ পুরো এলাকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা। ট্রাইব্যুনালে পূর্ব ফটক দিয়ে প্রবেশের সময় মানুষ ও যানবাহনে তল্লাশি করা হয়।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকেই ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রবেশপথের সামনের অংশ পুলিশ, আইনজীবী ও সাংবাদিকে ভরে যায়। গোলাম আযমকে বহনকারী গাড়ি সেখানে পৌঁছার পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাঁকে ট্রাইব্যুনালের ভেতরে নেওয়ার সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের আলোকচিত্র সাংবাদিক, সাংবাদিক ও কর্তব্যরত পুলিশের মধ্যে ব্যাপক ধাক্কাধাক্কি হয়।
‘আদেশ সঠিক নয়’: আদেশের প্রতিক্রিয়ায় আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের ওপর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই বলছি, এই আদেশ একদমই সঠিক নয়। আবদুল আলীমকে যে কারণে জামিন দেওয়া হয়েছিল, সেই একই কারণে গোলাম আযমকে জামিন দেওয়া উচিত ছিল। তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, যদিও এখনো আমরা জানি না তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। দেশে-বিদেশে সবাই ট্রাইব্যুনালের আইনকে সমালোচনা করেছেন, কারণ এখানে আপিলের সুযোগ নেই, সাংবিধানিক অধিকার নেই।’
‘বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছি’: আদেশের প্রতিক্রিয়ায় গোলাম আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা প্রসিকিউটররা দায়িত্ব পালন করেছি এবং যথার্থভাবে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছি।’ তিনি বলেন, এই আদেশ সুখকর ও আইনসিদ্ধ। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, জামিনের সিদ্ধান্ত যেন মূল মামলাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। বিচারকে কেন্দ্র করে কোনো ত্রুটি যেন না থাকে এবং বয়স ও অসুস্থতার বিবেচনায় তাঁকে যেন জামিন দেওয়া না হয়।
কারাগার থেকে হাসপাতালের প্রিজন সেলে: দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গোলাম আযমকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। তাঁকে কারাগারের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে করে কারাগার থেকে বিকেল তিনটা ৫০ মিনিটে নেওয়া হয় বিএসএমএমইউ হাসপাতালের প্রিজন সেলের সামনে। এ সময় আলোকচিত্র সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে কিছুটা ধস্তাধস্তি হলে কয়েক মিনিট অ্যাম্বুলেন্সেই রাখা হয় গোলাম আযমকে। পরে সাংবাদিকদের দূরে সরিয়ে তাঁকে প্রিজন সেলে নেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
বিএসএমএমইউ হাসপাতাল সূত্র জানায়, একপর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে গোলাম আযমকে হূদেরাগের জরুরি বিভাগের ১০২ নম্বর কক্ষে রাখা হয়।
কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) গোলাম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারাগারে আনার পর চিকিৎসকেরা গোলাম আযমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। এ কারণেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের পরামর্শ অনুসারে তাঁকে রাখা হবে।’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাধ্যক্ষ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গোলাম আযমকে হাসপাতালের কারা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা নেই: বিএসএমএমইউর হূদেরাগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লিখে দিয়েছি যে তাঁর হাসপাতালে থাকার দরকার নেই। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না। তিনি বলেছেন, তেমন কোনো সমস্যা নেই। এই সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাঁর হূদ্যন্ত্র ও ব্লাড সুগারের কোনো সমস্যা নেই। কিডনিও ভালো আছে। তবে রক্তচাপ ও প্রোস্টেটে সামান্য সমস্যা আছে। আমরা তাঁর রক্তচাপের ওষুধগুলো পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছি।’

No comments

Powered by Blogger.