উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেমে গেছেঃ দেশ চলছে কোন পথে

হাজোট সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় উন্নয়নমূলক বা অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয় স্থান পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশজুড়ে শিল্পোত্পাদন স্থবির হওয়ার পাশাপাশি রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষা বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা দূরে থাক, পুরনোগুলোও টিকে থাকতে পারছে না। জ্বালানি সঙ্কট স্থায়ী হয়ে উঠেছে।
বিদ্যুৎও গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি দূর হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলের বেকার ও অভাবী মানুষ শহরে ছুটে আসছে। কাজের খোঁজে ভিড় জমাচ্ছে এখানে ওখানে। ভিক্ষুক ও ভাসমান ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। এসবই সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। নতুন সরকারের প্রথম বছর শেষ হতে চললেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতির চিত্র মিলছে না।
সরকারি রিপোর্ট থেকেই জানা যায়, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও ঘোষিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। ১২টি মন্ত্রণালয় প্রথম তিন মাসে এডিবির ১ টাকাও খরচ করতে পারেনি। এ অবস্থায় বিগত অর্থবছরে এডিবি বাস্তবায়নের হার ৮৬ শতাংশের ধারে কাছে এবার যেতে না পারার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। শিল্প বিনিয়োগ থেমে গেছে। অন্যান্য খাতেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ নেই। ফলে শেয়ার আর সঞ্চয়পত্র কিনতে ঝুঁকছে মানুষ। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। ব্যাংকগুলোতে রিজার্ভ উপচে পড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড সৃষ্টি হলেও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হচ্ছে না। সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। জনশক্তি রফতানিও প্রায় বন্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়লেও ঐতিহ্যবাহী পাটের বাজার আমাদের হাতছাড়া হয়ে ভারত-চীনের দখলে চলে যাচ্ছে। এসব নিয়ে লেখালেখি যতই হোক, নজর দেবার কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত অন্যসব বিষয় নিয়ে।
অব্যাহত জ্বালানি ঘাটতি, অবকাঠামোগত সমস্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে আস্থার অভাব দেশে বিনিয়োগের পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়দের মতো বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এসব বিষয়ে আস্থা রাখতে পারছে না। শিল্পোত্পাদনের গতি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠায় রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি ও নিট পোশাকের বাজারে থাবা বসাচ্ছে ভারত, চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশ। এ সরকারের সময়কালে দেশে রফতানি হ্রাস পেয়েছে, বৈদেশিক অর্থায়ন কমে গেছে, রাজস্ব আয়েও ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্র ও পাটকল শ্রমিকদের ঈদের বোনাস-বেতন দেয়া অনিশ্চিত হয়ে ওঠা এবং সরকারি কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেল ঘোষণার ১৩ দিন পরও গেজেট ঘোষণা করতে না পারা থেকেই পরিস্থিতি যে কতটা নাজুক সেটা অনুমান করা যায়।
ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারে সরকারের গুরুত্বহীনতা ক্রমেই সবার চোখে ধরা পড়ছে। বিগত আমলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে গঠিত বেটার বিজনেস ফোরাম (বিবিএফ) সক্রিয় করে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। পদাধিকারবলে প্রধানমন্ত্রীই এই ফোরামের প্রধান। তারপরও এ পর্যন্ত একটি বৈঠকও হয়নি বিবিএফের। একইভাবে অকার্যকর হয়ে আছে বিনিয়োগ বোর্ড ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশন। পদে থাকাটা অর্থহীন হয়ে ওঠায় ঘোষণা দিয়ে রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের (আরআরসি) প্রধান ড. আকবর আলি খানের পদত্যাগের পরও এ নিয়ে সরকারের কোনো আগ্রহ-উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সরকারের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও দ্বন্দ্ব-বিরোধ-অসন্তোষ গভীর হয়ে উঠেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বৃদ্ধিই সেটা প্রমাণ করে। ঘোষণার মধ্যেই মন্ত্রণালয়গুলোর প্রকল্প আটকে থাকছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থবিরতার ফলে এমপিওভুক্তির আবেদন পড়ে আছে তিন হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ১৮ লাখ ছাত্রীর উপবৃত্তির টাকা দেয়াও বন্ধ হয়ে আছে ১১ মাস ধরে। এভাবে অচলাবস্থা ছড়িয়ে পড়লে দেশের ভবিষ্যত্ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।

No comments

Powered by Blogger.