ভাসানী ও শেখ মুজিবঃ একটি আলোচনা by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন

৭ নভেম্বর, ২০০৯ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন এ দেশের কৃষক-শ্রমিক খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষের পক্ষে তার নিজস্ব চেতনার গণ্ডিতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা।
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম যাদের নিয়ে তিনি দল গঠন করেছিলেন তাদের অনেকের কাছেই জনস্বার্থ বড় বিষয় ছিল না, রাষ্ট্রক্ষমতায় যেনতেন প্রকারে অধিষ্ঠিত হওয়াই ছিল তাদের আসল লক্ষ্য। এই কারণে তাদের সঙ্গ বাধ্য হয়েই ত্যাগ করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে।
পৃথিবীর যে অংশটি নিয়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ভৌগোলিকভাবে তার স্বতন্ত্র সত্তার উদ্ভব ১৯৪৭ সালে। বাংলাদেশকেন্দ্রিক রাজনীতির সূচনা প্রচ্ছন্নভাবে তখনই ঘটেছিল। দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সে সাক্ষ্যই বহন করে। মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় আওয়ামী মুসলিম লীগ তিনটি প্রধান দফার কথা ঘোষণা করে। এ তিনটি দফা ছিল : ১. পূর্ণ গণতন্ত্র, ২. পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং ৩. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি।
পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা ভাসানী ও শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচি হিসেবে ২১ দফা গৃহীত হওয়ায় ভাসানীর ৩ দফা আলাদা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। কারণ ২১ দফার মধ্যেই এর মর্মকথা অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাকিস্তানের অবহেলিত প্রদেশ পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তান) ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ’৫৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শেরেবাংলা একে ফজলুল হক একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে। এতে গণতন্ত্রী দল, নেজামে ইসলাম পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি এবং খেলাফতে রব্বানী পার্টি যোগদান করেছিল। যুক্তফ্রন্টের তৃতীয় নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। হক-ভাসানী-সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন এই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচি হিসেবেই ঘোষিত হয়েছিল ২১ দফা।
ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে ব্যস্ত মুসলিম লীগের দুর্নীতি ও দুঃশাসন এবং স্বায়ত্তশাসনের অধিকারবঞ্চিত পূর্ব বাংলার প্রতি শোষণ, বৈষম্য আর নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত ২১ দফা এত অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়েছিল যে, ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৭টিতেই জিতেছিলেন যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা। ৭২টি অমুসলিম আসনেও যুক্তফ্রন্ট সমর্থিতরাই জয়লাভ করেছিলেন, ফলে ৩০৯ আসনের প্রাদেশিক আইন পরিষদে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভাগে জুটেছিল মাত্র ১০টি আসন।
এরপর পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছে—গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের সরকারও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়ও যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যোগদান করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন; কিন্তু ২১ দফা বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য স্বীকার্য, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের শাসনকালে ১ নং দফাটি বাস্তবায়িত হয় এবং আরও বাস্তবায়িত হয় ১৪ নং দফাটির অংশবিশেষ।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে ১ নং দফাটি ছিল ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।’ আর ১৪ নং দফাটি ছিল, ‘জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করতঃ, বিনাবিচারে আটক বন্দিদের মুক্তি দেয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে।’
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমী। এদিকে রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ১৪ নং দফার আংশিক প্রতিশ্রুতি পালন করলেও সরদার ফজলুল করিমসহ কমিউনিস্ট বন্দিদের অনেকেই মুক্তিলাভ থেকে বঞ্চিত থেকে গিয়েছিলেন। তাছাড়া সভা-সমিতি করার ‘অবাধ ও নিরঙ্কুশ’ অধিকারও আওয়ামী লীগ শাসনকালে ভোগ করা যায়নি। কালাকানুন রদ করতে নেতারা তখনও উত্সাহিত হননি, পরেও না।
এই দিক থেকে হিসাব মেলাতে গিয়ে বলা যায়, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগ ২১ দফার দেড় দফা বাস্তবায়ন করেছিল। আর বাকি সাড়ে ১৯ দফার দামে মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে পূর্ব বাংলাকে যথেচ্ছ শোষণ করার অখণ্ডনযোগ্য দাসখতে সিল-সই মেরেছিল মারী চুক্তি সম্পাদন ও যুদ্ধজোটের পক্ষে ওকালতি করে।
এ ক্ষেত্রে পাঠকসমাজকে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মধ্যে ১৯ নং দফাটি স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এ দফায় বলা হয়েছিল, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসমূহ) পূর্ব বঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।’
২১ দফার এই ১৯ নং দফাটিকে এই সময় মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে দাফন করা হলেও ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফার ঘোষণা এসেছিল মূলত এই ১৯ নং দফাকে ভিত্তি করেই।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনোত্তর ঘটনাপ্রবাহ ছিল ওই বিজয়ের চেয়েও বিস্ময়কর। ক্ষমতালাভের আগেই মন্ত্রিত্বের প্রশ্নে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন ধরেছিল। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের সভায় শেরেবাংলা ফজলুল হককে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়। সমঝোতার সে চমত্কার পরিবেশে সোহ্রাওয়ার্দী শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপন করলে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ফজলুল হক শেখ মুজিবকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। এই বিতর্ককে কেন্দ্র করেই যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পরিণামে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েই ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল শেরেবাংলা ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের নামে গঠন করেছিলেন নিজ দলীয় সরকার। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পর ক্ষমতাসীন হয়েছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করেন, আর সোহ্রাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ১২ সেপ্টেম্বর। আওয়ামী লীগ সরকারও ২১ দফার একটির অংশবিশেষ মাত্র পূরণ করেছিল। অধিকাংশ রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তবে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি উপেক্ষিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বলতে শুরু করেন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলাকে ‘শতকরা ৯৮ ভাগ’ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। আতাউর রহমান খান, আবুল মুনসুর আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগদলীয় ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষাবলম্বন করেন। সে অবস্থায় সংগঠনের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী দলীয় কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। ১৯৫৭ সালের ৭/৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এবং ‘কাগমারী সম্মেলন’ নামে পরিচিত অধিবেশনটিতেও সোহ্রাওয়ার্দী তার ‘শতকরা ৯৮ ভাগ’ স্বায়ত্তশাসনের তত্ত্বই পেশ করেছিলেন। জবাবে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে উচ্চারণ করেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি ‘আস্সালামু আলাইকুম’।
কাগমারী সম্মেলনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পাস হয়ে যায়; কিন্তু কাগমারী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সরকার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে নীরব ভূমিকাই রাখতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন ১৮ মার্চ, ১৯৫৭ সালে। উল্লেখ্য, ২১ দফা আদায়ের ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানীর অনমনীয় চাপের মুখে এর আগেই আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ২ মার্চের সভায় অবিলম্বে প্রাদেশিক পরিষদে সরকারিভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য দলীয় সদস্যদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রাদেশিক পরিষদে গৃহীত স্বায়ত্তশাসনের সর্বসম্মত প্রস্তাবটিকে প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দী ‘বিবেচনার অযোগ্য এক রাজনৈতিক চমক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোলাম আলী তালপুরও একে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করে ‘কঠোর হস্তে দমন করার’ হুমকি উচ্চারণ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে এরপর ১৩-১৪ জুন ঢাকায় আয়োজিত হয়েছিল এক ‘কাউন্সিল অধিবেশন’। এতে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধজোটমুখী পররাষ্ট্রনীতিসহ প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দীর সব নীতি ও ঘোষণাকেই অনুমোদন দেয়া হয়। দলীয় নীতি বিচ্যুতির অভিযোগে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ২৫ জুলাই তার উদ্যোগে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
এ পর্যন্ত উপস্থাপিত ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে বলা যায়, ১৯৫৪ সালের বিজয়োত্তরকালে পূর্ব বাংলার জননেতাদের গরিষ্ঠ অংশই ক্ষমতালিপ্সার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। এর ফলে জনগণের মঙ্গল ভাবনা উপেক্ষিত হয়েছে, স্থায়ী সর্বনাশ হয়েছে পূর্ববাংলার। ২১ দফা কিংবা স্বায়ত্তশাসন দূরে থাক, শোষণ-নির্যাতনই অব্যাহত থেকেছে, এতে জনগণ হয়েছে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ।
২১ দফার পরিণতি সম্পর্কিত পর্যালোচনার পর রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্য দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ৬ দফা এবং ১১ দফার বিষয় আলোচনায় আনা দরকার। ৬ দফা পেশ করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত হয়েছিল ১১ দফা কর্মসূচি ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর অনুসারী হিসেবে পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে প্রতিকূল অবস্থান গ্রহণের পর স্বায়ত্তশাসনের একই দাবি নিয়ে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের উত্থান ঘটে। ৬ দফার মাধ্যমে তিনি মূলত নতুন কোনো কর্মসূচি উপস্থাপিত করেননি। বস্তুত, ২১ দফার ১৯ নং দফার সম্প্রসারিত রূপই ছিল শেখ মুজিবের ৬ দফা। প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ মুজিব এই ৬ দফা কোথায় পেলেন? এ কথা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য এবং আওযমাী লীগ ও শেখ মুজিব কর্তৃক স্বীকৃতও যে, আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের কোনো সভায় বা বৈঠকে ৬ দফা কর্মসূচি আলোচিত বা গৃহীত হয়নি—পাকিস্তান আওয়ামী লীগে তো নয়ই, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনো ফোরামেও নয়। কথিত আছে শেখ মুজিব গেলেন করাচি হয়ে লাহোরে। লাহোরে তিনি পকেট থেকে বের করলেন ৬ দফা। ঢাকা-করাচি-লাহোর পথে অপরাপর যে সব আওয়ামী লীগ নেতা তার সহযাত্রী ছিলেন তারা পর্যন্ত কিছু জানতে পারেননি এক মুহূর্ত আগেও। অতঃপর লাহোর থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শেখ মুজিব ঘোষিত ৬ দফা অনুমোদন করে। ৬ দফা নিয়ে নানা কথা থাকলেও এর মূলে যেতে হলে ৬ দফার প্রেক্ষিতটাও আলোচনা করা দরকার।
শেখ মুজিব ৬ দফা দিয়েছিলেন ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৭ দিনের একটা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের ফলাফলটা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জন্য আনন্দদায়ক ছিল না। ফলে, তাসখন্দ চুক্তি করে তিনি দেশে ফিরলে প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখোমুখি হন।
এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আইয়ুব খানকে বিশেষভাবে পীড়িত করে। পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধজোটে আবদ্ধ। ভারত তখন জোট নিরপেক্ষ দেশ। সে ক্ষেত্রে আইয়ুব খানের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করবে; কিন্তু কার্যত যুক্তরাষ্ট্র সযত্নে এমন ভূমিকা থেকে বিরত থেকেছে, যা ভারতের অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৬২’র চীন-ভারত যুদ্ধের অজুহাতে এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র সরবরাহ করে আসছিল। এই অস্ত্রও স্বাভাবিক কারণেই পাক-ভারত যুদ্ধে ভারত ব্যবহার করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আইয়ুবের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। ক্ষুব্ধ আইয়ুব খান অতঃপর, আমেরিকার সেই সময়কার জানি দুশমন, চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন। পিকিংয়ে তাকে বিশ্ব নায়কোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, এরই সূত্র ধরে পরবর্তীকালে আইয়ুব খান ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে মার্কিন ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকেও ক্ষুব্ধ করেছিল। স্বাভাবিক কারণে, যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রয়োজন পড়েছিল আইয়ুব খানকে কিছুটা ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার।
৬ দফা কি আইয়ুব খানকে সেই ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার দফা হতে পারে না? এ ক্ষেত্রে ধারণাটিকে আরও পরিষ্কার করার জন্য যে সংযোগ সূত্রগুলো স্মরণ করা দরকার তা হচ্ছে :
১. মার্কিন রাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যখন উড়ে এসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনটিতে জুড়ে বসেছিলেন, তখন মার্কিন মদতপুষ্ট সে মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবের আদর্শিক নেতা সোহ্রাওয়ার্দীরও একটি সম্মানজনক আসন ছিল।
২. এই সোহ্রাওয়ার্দীই আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তার দল আওয়ামী লীগ প্রধান মওলানা ভাসানীর প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে যখন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ও বিভিন্ন যুদ্ধজোটের পক্ষে ওকালতি করেন, শেখ মুজিব গ্রুপ তখন দলের নেতা মওলানা ভাসানীর পরিবর্তে মার্কিনি ইচ্ছার বাহক ও ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দীকেই সমর্থন দিয়েছিলেন।
৩. পঞ্চাশের দশকে শেখ মুজিব সংখ্যাসাম্য, এক ইউনিট ও জাতীয় সংহতির প্রবক্তা। ৬ দফার বক্তব্য তার সম্পূর্ণ বিপরীত— স্বাধীনতার একেবারে কাছাকাছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কেও কিন্তু ৬ দফা সম্পূর্ণ নীরব।
৪. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে শেখ মুজিব চাকরি করতেন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নামক একটি বীমা প্রতিষ্ঠানে। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিল পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম হারুন গ্রুপ। আইয়ুব খান আবার ছিলেন এই হারুন গ্রুপের জানি দুশমন। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে আইয়ুব খান এই হারুন গ্রুপের প্রধান ব্যক্তিকে সামরিক আদালতের বিচারে বেত্রাঘাত দিয়েছেন, তাদের কোটি টাকার ব্যবসা নষ্ট করেছেন।
৬ দফাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শেখ মুজিবের রাজনীতির উত্থান আগেই উল্লিখিত হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোগত প্রস্তাব, যাতে কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র দুটি বিষয়—দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক নীতি রাখা হয়েছে (২ নং দফা)। অন্য দফাগুলো এই মূলনীতিরই ব্যাখ্যা। সুতরাং কোনো এক দফাকে বাদ দিয়ে অন্য দফার অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু এই শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে বিরোধ যখন একেবারে তুঙ্গে, তখন শেখ মুজিব পাকিস্তানকে রক্ষার চেষ্টা হিসেবে ৬ দফা বিসর্জন দিতে কিন্তু কার্পণ্য করেননি। ৬ দফাকে বাদ দেয়ার কথা বলা ’৭০-৭১ এর স

No comments

Powered by Blogger.