লোকাল হিরো-তিনি সবার খন্দকার স্যার

রসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাশিমপুর মৌলভীবাজারের প্রধান সড়কের পাশেই সামাজিক সংগঠন প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্র। চৌচালা টিনের ঘরের একটি কক্ষে ঢুকতেই চোখে পড়ল, একজন আশি-ঊর্ধ্ব বয়সী লোককে ঘিরে বেশ কিছু সংখ্যক লোক আলাপচারিতায় মত্ত। আসরের মধ্যমণি হয়ে যিনি বসে আছেন, তিনি সবার খন্দকার স্যার। পুরো নাম ফজলুল হক খন্দকার।


উপস্থিত গ্রামবাসী জানায়, এলাকার যেকোনো সমস্যা ও পরামর্শে সবাই ছুটে আসে খন্দকার স্যারের কাছে। সবার কথা শুনে সমাধান দেন তিনি। না পারলে সঠিক পথ ও পরামর্শ দেন। যুগ যুগ ধরে স্যারের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ নেওয়া গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো কোনোদিন প্রতারিত না হওয়ায় সবার কাছে অলিখিত 'নেতা'য় পরিণত হয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিটি।
ফজলুল হক খন্দকার ১৯২৬ সালের ৩ জুলাই রায়পুরা উপজেলার নিভৃত পল্লী বাহেরচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মিলাব আলী খন্দকার এবং মা সামিনা খাতুন। সাত ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সমাপ্ত করেন।
অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি রমেন মিত্র রায়পুরায় আত্মগোপনে ছিলেন। নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় এক বন্ধুর মাধ্যমে ফজলুল হক খন্দকারের সঙ্গে রমেন মিত্রের পরিচয় হয়। আলাপচারিতায় রমেন মিত্রের বাম রাজনীতির দর্শন তরুণ ফজলুকে আন্দোলিত করে। এতে তিনি এলাকায় বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রায়পুরা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন।
একসময় ঢাকায় রাজনীতি করলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রাজনীতিবিদদের নীতিচ্যুতির ঘটনায় ব্যথিত এই রাজনীতিবিদ পরবর্তীকালে চলে আসেন নিজ গ্রামে। গ্রামে এসে তিনি মনোনিবেশ করেন মানুষের কল্যাণে।
এরই অংশ হিসেবে তিনি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন সামাজিক সংগঠন চেতনা বিকাশ কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে করে থাকে। গ্রামের স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য স্থানীয় হাশিমপুর মৌলভীবাজারে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনা করেন।
একই সঙ্গে তিনি গ্রামে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন শতদল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং চেতনা বিকাশ মহিলা কলেজ। প্রতিষ্ঠান দুটিতে প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। পাশাপাশি তিনি রায়পুরা ডিগ্রি কলেজ এবং বারৈচা এএনএম উচ্চ বিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা।
'তুমি সুন্দরভাবে বাঁচো এবং সুন্দরভাবে বাঁচতে অন্যকে সাহায্য করো।'_ইংরেজি এক লেখকের এই বাক্যটি নিজের মধ্যে লালন করে মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন ফজলুল হক খন্দকার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা এই প্রবীণ রাজনীতিবিদের শরীরে বার্ধক্য জেঁকে বসেছে। কিন্তু এখনো দিন কাটে সমস্যাপীড়িত গ্রামের মানুষের ভিড়ে। তিনিও নিঃস্বার্থভাবে সবার সেবা করে যাচ্ছেন। বিনিময়ে সাধারণ মানুষ তাঁকে বসিয়েছে শ্রদ্ধার আসনে।

No comments

Powered by Blogger.