নেতারাই টের পাননি খালেদা কি বলবেন

কাফি কামাল, চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: নানা কারণে বিএনপি’র চট্টগ্রাম বিভাগীয় রোড মার্চটি হয়ে উঠেছিল বিরোধী দলের আন্দোলনে একটি বাঁক নির্ধারক। রাজনৈতিক মহলসহ সাধারণ মানুষের কৌতূহল ছিল সেখানেই। কোন দিকে বাঁক নেবে বিরোধী দলের আন্দোলন। চট্টগ্রাম থেকেই কি ‘ঢাকা ঘেরাও’, ‘ঢাকা অবরোধ’ কিংবা ‘ঢাকায় গণঅবস্থান’-এর  মতো কড়া কোন কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে দলটি। নাকি অন্য রকম কিছু? দলীয় নেতাকর্মীরাও ছিলেন দারুণ উদগ্রীব। কারণ মাসখানেক ধরেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছিল এমন কিছুই করতে যাচ্ছে বিএনপি। বিরোধীদলীয় নেতারাও নানা বক্তব্যে সে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। ফলে সবার মধ্যে ছিল নানা ধারণা। চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডের মহাসমাবেশটি জনসমুদ্রে রূপ নেয়ায়  মুহূর্তে মুহূর্তে    পৃষ্ঠা ২০ কলাম ১
বাড়ছিল সে কৌতূহল। তখনও নেতারাই টের পাননি খালেদা জিয়া কি বলবেন। কিন্তু না, জনতার জোয়ার দেখেও বিভ্রান্ত হননি খালেদা জিয়া। ৪২ মিনিট বক্তব্যের পুরো সময় কড়া সুর ধরে রাখলেও ‘হঠাৎ কিছু’ করার দিকে যাননি। টানা ২ মাস সময় দিয়ে ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ স্লোগানে ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। অন্য গণমিছিলের কর্মসূচিটিও অনেকটাই গতানুগতিক। এমন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি ঘোষণার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সামনে এসএসসি পরীক্ষা। জনগণের দল হিসাবে জনগণের কথা চিন্তা করেই এমন নরম কর্মসূচি দিচ্ছি।
চট্টগ্রামের জনসভায় খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছিল তীক্ষ্ণ এবং ধারালো। সরকারের সমালোচনায় তার কণ্ঠে ছিল শ্লেষ। করেছেন রসিকতাও। তবে তিনি আরেকটি জায়গায় পরিচয় দিয়েছেন বিচক্ষণতার। সরকারের তরফ থেকে ‘রোড মার্চ এবং সমাবেশকে’ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার আন্দোলন বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। খালেদা জিয়া নিজেও বিভিন্ন রোড মার্চে এ প্রসঙ্গে খোলাখুলি বক্তব্য দিয়েছেন। তবে চট্টগ্রামের বিপুল জনসমুদ্রের মুখরিত স্লোগান, করতালির মধ্যেও তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুটি। চট্টগ্রামের মতো জায়গায় এত বিপুল সমর্থনের ভেতরেও তার এ এড়িয়ে যাওয়াকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তবে কেউ কেউ তার এ এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে বিএনপি’র নীতিনির্ধারক ফোরামে চট্টগ্রামের একমাত্র প্রতিনিধি এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাবন্দি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রসঙ্গে তার নীরবতা। হতাশার আরেকটি জায়গা হচ্ছে- অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রামের ভবিষ্যত উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট কোন অঙ্গীকার বা বক্তব্য না দেয়া। রাজনৈতিক সচেতনদের মতে, খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও কর্মসূচি ঘোষণায় একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি বর্তমান নির্বাচিত সরকারের অসময়ে পতন চান না। যার সূত্র ধরে দেশের ক্ষমতার কলকাঠি নাড়াতে পারেন অনির্বাচিত কেউ। তিনি চাইছেন, নির্ধারিত মেয়াদের শেষে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হোক। এছাড়া তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে একটি সতর্ক বার্তাও দিয়েছেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে মেয়র নির্বাচন যত সুষ্ঠু হোক এটা কোন ধর্তব্যের বিষয় নয়। জাতীয় নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন কমিশনই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। ফলে রোড মার্চের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির ইস্যুটি গণমানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়া।
চট্টগ্রাম রোড মার্চ নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সাধারণ মানুষের কৌতূহল ছিল আরেকটি জায়গায়। বিএনপি কি আগের রোড মার্চের স্বতঃস্ফূর্ততা ধরে রাখতে পারবে? কারণ আগের দিন ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের নানা অসহযোগিতার অভিযোগ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতারা। প্রকাশ করেছেন নানা আশঙ্কার কথা। এছাড়া চট্টগ্রাম বিএনপি’র অন্তর্কোন্দলের সুদীর্ঘ ইতিহাসতো আছেই। দুই সপ্তাহ আগেই প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল দুই গ্রুপ। কিন্তু অন্যরকম এক বিএনপিকে দেখেছে চট্টগ্রাম। দায়িত্ব নিয়ে পাল্টাপাল্টি, সমাবেশে কর্মীদের জায়গা দখল, মঞ্চে নেতাদের অবস্থান নিয়ে দেখা যায়নি ন্যূনতম বিরোধ। সহনশীল মনোভাব এবং দায়িত্বের প্রতি সজাগ ছিলেন সকলেই। অন্যদিকে এ রোড মার্চকে ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীসহ সমর্থকদের প্রত্যাশাও ছিল ব্যাপক। তৈরি হয়ে ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জও। তবে ব্যাপক প্রচারণা, সার্বিক প্রস্তুতিসহ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে রোড মার্চটি হয়ে ওঠে বর্ণাঢ্য। রোড মার্চে জনতার ঢল দেখে অনেক রাজনীতি সচেতন প্রবীণকেও বলতে শোনা গেছে, এমন গণজোয়ার কখনও দেখেনি চট্টগ্রাম। অশীতিপর বৃদ্ধরাও মন্তব্য করেছেন আয়োজন এবং উপস্থিতির দিক থেকে এটাই চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সমাবেশ। যে সমাবেশে অংশ নিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকার মানুষও। এমন বিপুল উপস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে চট্টগ্রাম বিএনপি। রীতিমতো আশ্চর্য রকম ব্যতিক্রম ছিলেন সমাবেশের সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। রোড মার্চকে ঘিরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সব নেতার ব্যানার-বিলবোর্ডের ছড়াছড়ি থাকলেও প্রতিযোগিতায় নামেননি তিনি। চট্টগ্রাম নগরীর কোথাও দেখা যায়নি তার ছবি সংবলিত কোন পোস্টার এবং বিলবোর্ড। শহরের দু-তিনটি জায়গায় স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগে তার ছবি দিয়ে বিলবোর্ড লাগানো হলেও তিনি জরুরি নির্দেশ দিয়ে তা দ্রুত নামিয়ে ফেলেন। নগর বিএনপির ব্যানার-পোস্টারেও ছিল না তার ছবি। এদিকে মহাসমাবেশ সফল করার জন্য চট্টগ্রামবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বিএনপি’র দুই সিনিয়র নেতা কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান এবং নগর বিএনপি’র সভাপতি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। কৃতজ্ঞতা বার্তায় তারা বলেছেন, পলোগ্রাউন্ডের মহাসমাবেশ অত্যন্ত সুষ্ঠু, সার্থক ও সুন্দরভাবে সফল হওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
ওয়ান ইলেভেনের পর প্রথম চট্টগ্রাম সফরে স্থানীয় চার শীর্ষ নেতার বাসায় গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। জনসভা থেকে একে একে তিনি নেতাদের বাসায় ঢুঁ মেরেছিলেন। এবার তিনি নেতাদের বাসায় না গেলেও দুপুরে খেয়েছেন মাঝারি দুই নেতার বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার। খালেদা জিয়াসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের জন্য সার্কিট হাউজে ৩০ পদের তরকারি বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকার এবং ২০ পদের তরকারি মেয়র মনজুর আলমের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়। এছাড়া বিরোধী দলের সমর্থনে মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী মনজুর আলমও এবার চেষ্টা করেছেন ঋণ পরিশোধের। রোড মার্চের প্রচারে তিনিই ছিলেন এগিয়ে। একদা আওয়ামী লীগ নেতা মনজুর এ মহাসমাবেশে প্রথমবারের মতো বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি’র মঞ্চে। বিএনপি নেতারা স্বীকার করেছেন তার অকুণ্ঠ সহযোগিতার কথা।

No comments

Powered by Blogger.