গোলাম আযম কারাগারে-কারা হেফাজতে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের শুনানি

স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্মান্তরকরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া ১২টায় তাকে ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রিজন ভ্যানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।


এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বিচারের মুখোমুখি হলেন বহুল আলোচিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আযম। তবে কারাগারে নেওয়ার পর গোলাম আযম অসুস্থবোধ করলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন।
এর আগে সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল তার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। একই সঙ্গে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি গোলাম আযমের উপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এদিকে গোলাম আযমকে গ্রেফতারের ঘটনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ। তারা বলেছেন, তাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে জাতির ৪০ বছরের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণের খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার ট্রাইব্যুনালের দেওয়া আদেশ অনুযায়ী গতকাল সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হন গোলাম আযম। আদেশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে গোলাম আযম বলেন, 'আমি বাংলাদেশের জন্য দোয়া করি। আপনারাও আমার জন্য দোয়া করবেন।'
আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কেঁৗসুলি
গোলাম আরিফ টিপু বলেন, আমরা যথাযথ দায়িত্ব পালন শেষে বিজয়ের বেশে ফিরে এসেছি। এই আদেশ ছিল সুখকর ও আইনসিদ্ধ। অপরদিকে গোলাম আযমের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, জামিন না দেওয়ার আদেশটা সঠিক নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই।
এদিকে গোলাম আযমকে গ্রেফতারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন সকাল থেকে ট্রাইব্যুনালের সামনে অবস্থান নেয়। ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে মানববন্ধন করে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। হাইকোর্টের মাজার গেট দিয়ে জনসাধারণের প্রবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
আদেশ : আদেশে বলা হয়েছে, 'বয়স নয়, অপরাধই বিবেচ্য'। আবদুুল আলীমের জামিনের সঙ্গে গোলাম আযমের করা আবেদনের পার্থক্য রয়েছে। আলীমের বিরুদ্ধে এখনও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা না হলেও গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে। আদেশের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এক কোটি মানুষ জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হয়েছেন। দেশের সব শ্রেণীর মানুষ এসব বর্বরতার ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে। একাত্তরের বর্বরতার কথা আসামি পক্ষও অস্বীকার করেনি। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্বরতার জন্য কে দায়ী তা বিচারেই ঠিক হবে। এ অবস্থায় আমরা আসামিকে জামিন দিতে পারি না। তার জামিন না-মঞ্জুর করা হলো। এ ছাড়া গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণের ওপর আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করা হয়। একই সঙ্গে আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে মামলার নথিপত্র ও সাক্ষীদের নামের তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে বলা হয়। রোববারের মধ্যে আসামি পক্ষকে নথি সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
এ সময় মৌখিকভাবে কারাগারে গোলাম আযমকে ডিভিশন দেওয়ার আবেদন করা হলে তাও খারিজ করেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলা ও অভিযোগ : গত ৫ জানুয়ারি স্বাধীনতা যুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৬২টি ঘটনায় শতাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়। একই সঙ্গে ওই আবেদনে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে বলা হয়। একশ' পৃষ্ঠার ফরমাল চার্জের সঙ্গে ত্রিশ খণ্ডে কয়েকশ' তথ্য-প্রমাণ দাখিল করা হয়। চার্জে বলা হয়েছে, গোলাম আযম ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২), ৪(১) ও ৪(২) ধারার অপরাধ করেছেন।
শুনানি ও আদালতের চিত্র : সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শুরু করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এর আগে মঙ্গলবার গোলাম আযমের পক্ষ থেকে বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যগত বিষয়টি বিবেচনার জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন আবেদন করা হয়। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনালের ৯ জানুয়ারির আদেশ অনুসারে গোলাম আযমকে হাজির করা হয়েছে। তার বর্তমান বয়স ৮৯ বছর। তিনি আর্থ্রাইটিস, হাইপারটেনশন ও ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। তিনি বলেন, এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আবদুল আলীমকে শর্তসাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় গোলাম আযমকে জামিন দেওয়া হোক।
জামিন আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কেঁৗসুলি গোলাম আরিফ টিপু বলেন, ৪০ বছর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যে গণহত্যা, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাট ও ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছিল সব ছিল গোলাম আযমের নেতৃত্বে। আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়নি। কিন্তু গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। গোলাম আযম ও আবদুল আলীমের মামলার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তিনি আরও বলেন, আবদুল আলীম শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিনি হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। গোলাম আযমের বয়স ৮৯ বছর হলেও তার স্বাভাবিক চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারের প্রয়োজন হয় না। তিনি প্রতিনিয়ত মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। তার জামিন আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। তাকে জামিন দেওয়া হলে মূল মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই অপরাধের অভিযোগে অন্য আসামিরা কারাগারে এবং বয়সের কারণে তার জামিন মঞ্জুর করা সঠিক হবে না। এ সময় তিনি মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনায় আমেরিকার নাগরিক জাংজুইনের বিচারের বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন।
ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযম : সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে গোলাম আযম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে হাজির হন। এ সময় তাকে হুইল চেয়ারে করে দোতলায় আনা হয়। তার গায়ে ছিল ক্রিম কালারের শেরওয়ানি, আকাশি রঙের হাফ সোয়েটার ও মাথায় জিন্না টুপি। এরপর রেজিস্ট্রারের নির্দেশে তাকে কাঠগড়ায় বসানো হয়। এ সময় তার বড় ছেলে আবদুল্লাহ হিল আমান আযমী কাঠগড়ায় পাশে বসা ছিলেন। সাড়ে ১০টায় ট্রাইব্যুনাল বসলে তিনি দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে সালাম দেন।
আদালতের বাইরের চিত্র : গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার আগেই পুরাতন হাইকোর্টের সামনে মানববন্ধন করে বিভিন্ন সংগঠন। এসব মানববন্ধন থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর দাবি জানানো হয়। পৃথকভাবে আয়োজিত এ মানববন্ধনে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ-'৭১, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, প্রজন্ম '৭১, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় মুট কোর্ট সোসাইটির নেতাকর্মীরা অংশ নেন। এসব মানববন্ধনে সাধারণ পথচারীরাও অংশ নিয়ে গোলাম আযমের গ্রেফতার দাবি করেন।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতা ও পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেন, 'গোলাম আযম কুখ্যাত অপরাধী। সে বাইরে থাকলে সাক্ষীরা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে ভয় পাবে।' শাহরিয়ার কবির বলেন, 'গোলাম আযম বাইরে থাকলে মামলার তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করে ফেলবে। তাই তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে কারাগারে নেওয়া প্রয়োজন।' এছাড়া মানববন্ধন কর্মসূচিতে সেক্টর কমান্ডার সাবেক সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহ ও লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শাহিন রেজা নূর, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী প্রমুখ অংশ নেন।
মগবাজার থেকে কারাগার : বুধবার সকাল সাড়ে ৭টা। রাজধানীর বড় মগবাজারে ১১৯ নম্বর বাড়িটি ঘিরে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। তার আগেই ভোর পৌনে ৬টায় বাড়িটির সামনে অবস্থান নেয় গোলাম আযমের অনুগত জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। কাজী অফিস গলির মুখে প্র্রস্তুত পুলিশ ও র‌্যাবের গাড়ি। পুরো এলাকাজুড়ে গোয়েন্দাদের সতর্ক নজরদারি। ধীরে ধীরে ওই বাড়িটির সামনে উৎসুক জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। সাড়ে ৯টার দিকে একটি হুইল চেয়ারে করে বাসা থেকে বের করা হয় গোলাম আযমকে। একটি নীল রঙের প্রাইভেটকারে তাকে ওঠানো হয়। সঙ্গে ওঠেন ছেলে আবদুল্লাহ হিল আমান আযমী ও তার আইনজীবী। গোলাম আযমকে বহনকারী গাড়ির সামনে-পেছনে পুলিশ আর র‌্যাবের গাড়ির সতর্ক নিরাপত্তা। মগবাজার থেকে ফাঁকা রাস্তায় পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমকে বহনকারী গাড়িটি পেঁৗছে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে। এরপরই তাকে নেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে। শুনানি শেষে আদালত গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

No comments

Powered by Blogger.