ঈদে বাড়ি ফেরার বিড়ম্বনাঃ ভ্রমণ যেন বিপজ্জনক না হয়

দের ছুটিতে বিশেষত শহরের কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়া আমাদের সংস্কৃতির এক অনিবার্য দিক। আর মাত্র তিন দিন পরই ঈদ। এখন থেকেই ঘরে ফেরার জন্য দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়েছে। বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকিট পেতে লম্বা লাইন হচ্ছে টার্মিনালের কাউন্টারে। তবে ফি বছরের মতো এবারও আগাম টিকিট কেনা নিয়ে বিস্তর বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন লোকজন।
এরই মধ্যে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। ফলে রাতভর অপেক্ষা করেও টিকিট না পেয়ে ফিরে গেছেন শত শত মানুষ। লঞ্চের টিকিটের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটছে। টিকিট জোগাড় করতে না পেরে চরম উত্কণ্ঠায় আছেন অসংখ্য ঘরমুখো মানুষ। জানা গেছে, এবারও দূরপাল্লার বাস, লঞ্চ, ট্রেনের টিকিট নিয়ে কালোবাজারি হয়েছে, হচ্ছে। কাউন্টার শূন্য করে টিকিট চলে গেছে কালোবাজারিদের হাতে। এ অবস্থায় বেশি দামে টিকিট কেনার জন্য কালোবাজারিদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
এদিকে চিরাচরিত নিয়মে যানবাহনের কর্মকর্তারা অজুহাত তৈরি করে বসে আছেন। তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগাম টিকিট বিক্রি শেষ হওয়ায় সব ট্রেনেই নির্ধারিত আসন ছাড়াও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের ব্যবস্থা থাকবে। যারা আগাম টিকিট কিনতে পারেননি তারা নির্ধারিত দামে টিকিট কিনে পুরো পথ দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর এ সুযোগে অনেকে আপাতত তুষ্ট হলেও মুশকিল হচ্ছে তাদের যারা শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা ও অসুস্থ লোকজন নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান। এ অবস্থায় তাদের ভাড়া গাড়ি ছাড়া বিকল্প থাকবে না। দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। এদিকে নগরীর অন্যতম বড় বাস টার্মিনাল গাবতলীতে টিকিট না পেয়ে হতাশ লোকজন অভিযোগ করেছেন, কালোবাজারে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে। বাস কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আগেভাগেই টিকিট কিনে রেখেছেন। সেগুলোই এখন চড়া দামে বিক্রি করে নিরুপায় যাত্রীদের ওপর খাঁড়ার ঘা হানছেন। কালোবাজারি রুখতে পুলিশি নজরদারি বাড়িয়েও তেমন কিছু ফায়দা হয়নি। দালালদের হাতসাফাই ধরার কোনো উপায় পাচ্ছেন না তারা। লঞ্চের টিকিটের ক্ষেত্রে কালোবাজারিতে নেমেছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। তারা অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে কেবিনের টিকিট। এক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকা প্রায় শূন্য।
এসব বিড়ম্বনা অবশ্য বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। প্রতি ঈদের ঘুরেফিরে বিদ্যমান বিড়ম্বনার সঙ্গে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। সঠিক সময়ে উচিত দামে টিকিট না পাওয়া এবং পর্যাপ্ত যানবাহন না পাওয়ার বিষয়টি এখন প্রায় গা-সওয়া হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। আর এ সুযোগটিই লুফে নেয় একশ্রেণীর যানবাহন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে কালোবাজারিরা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বিশেষত সড়কপথে এখন দেশের প্রায় সব গন্তব্যেই যাওয়া সম্ভব। বর্ধিষ্ণু পল্লীতেও এখন বাসসহ অন্যান্য যানবাহন যেতে পারে। আগে যেসব স্থানে কেবল নদীপথে যাওয়া যেত, সেখানেও এখন বাসের সড়ক হয়েছে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বহুগুণে সহজ হয়েছে। অথচ দুর্ভোগ বেড়েছে আগের তুলনায় বহুগুণ। বিভিন্ন জাতের যানবাহনের সংখ্যা বাড়া সত্ত্বেও সমস্যা কেবলই সঙ্কটাকীর্ণ হচ্ছে। তার কারণ বাড়তি জনসংখ্যা। তাছাড়া জীবিকাসন্ধানী মানুষের ভিড় প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে শহরে। এ অবস্থায় ঈদ পালনে বাড়ি ফেরা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বেশি দামে টিকিট কিনেও শেষ পর্যন্ত সহি-সালামতে বাড়ি ফেরা যাবে—এমন গ্যারান্টি নেই। নদীপথে এই শুকনো মৌসুমে ডুবোচরে লঞ্চ আটকে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকেই। শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় যানজট বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া দরকার। একই সঙ্গে কালোবাজারি দমন করতে শুধু পুলিশের সংখ্যা বাড়ালেই চলবে না, বাড়াতে হবে নজরদারি। সবাই জানেন, অতিরিক্ত যাত্রীবহন করার ফলে বরাবরই দুর্ঘটনা ঘটে। এদিকেও সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বাড়তি আয়ের আশায় কোনো যানবাহনে যাতে অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো না হয়, সে ব্যাপারে পুলিশি তদারকির পাশাপাশি যাত্রীসাধারণকেও সজাগ থাকতে হবে। মোট কথা, ঈদে ঘরে ফেরা আরামদায়ক না হলেও তা যেন বিপজ্জনক না হয়ে যায়—এটাই কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.