অভিমতঃ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) নিয়ে কিছু কথা by এম আলম খান

জাতীয় শিক্ষানীতির প্রথম অধ্যায়ে ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’র প্রথম লাইনেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে বিবৃত সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাগুলো বিবেচনা করা হয়েছে এবং ১নং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে উল্লেখ রয়েছে— শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের সচেতন করা।
আসলেই কি সম্পূর্ণভাবে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে, নাকি কাটছাঁট করা হয়েছে? তাহলে সংবিধানের মূলনীতিতে কী বিবৃত আছে তা দেখা যাক।
সংবিধানের প্রথম ভাগের ২ক. অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্ম প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ এছাড়াও সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতিগুলোর ৮(১ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।’ কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এর ১ থেকে ২৪ প্যারার বা পয়েন্টের মধ্যে কোথাও ইসলামী ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা উল্লেখ নেই। এটা অন্তত ৮৮ ভাগ থেকে ৯০ ভাগ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষের জন্য লজ্জাকর। ইসলাম বিশ্বজনীন মানবধর্ম, ইসলামী মূল্যবোধ মানবজীবনের সর্বস্তরে অপরিহার্য। জাতীয় শিক্ষানীতির ২নং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ‘ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলা হয় নাই।” আমাদের মনে রাখতে হবে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলমান, তারা জীবনের প্রতিটি স্তরে ধর্ম-কর্ম করে থাকে। তাছাড়া আমাদের দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান বিভিন্ন সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক মঞ্চে ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের চরিত্র গঠনে ও মানবজীবনে কল্যাণ বয়ে আনে ইত্যাদি সুন্দর বক্তব্য দিয়ে থাকেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিটি কাজের প্রারম্ভে আল্লাহ তায়ালার নাম স্মরণ করেন এবং তার দেয়া নিয়ম ও বিধান মেনে চলেন ও পালন করেন, তাছাড়াও মুসলিম পারিবারিক আইন আমাদের দেশে বলবত্ আছে। মুসলিম আইন ছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় আইনও বলবত্ আছে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় জ্ঞানলাভ করা প্রতিটি মানুষের অধিকার ও অপরিহার্য। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক স্তরেই ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে থাকে। এটাই আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। বিজাতীয় ভিন্ন ভাবধারার কোনো সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জীবনে ও কর্মে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা এদেশের মানুষ মানবে না। প্রকৃত গণমুখী শিক্ষার গুরুত্ব দিতে হলে এদেশের ধর্মভীরু জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ধর্ম মানুষকে নৈতিক, সামাজিক, মননশীল, যুক্তিবাদী, অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দেশপ্রেমিক, পরমতসহিষ্ণু, কর্মকুশল ও ধার্মিক হিসেবে গড়ে তোলে। যাদের সর্বশক্তিমান আল্লাহ ও ধর্মে বিশ্বাস নেই তাদের হয়তো আমার এ কথা ভালো না লাগতে পারে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাঙালি, অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষতা ইত্যাদি কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও খুব একটা বিবেচ্য বিষয় নয়। জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক স্তর অথবা উচ্চশিক্ষা লাভ করার পর শিক্ষাব্যবস্থায় প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ন্যূনপক্ষে এক বছর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অথবা নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে ব্যবহারিক/ইন্টার্নিশিপ অন্তর্ভুক্ত করা খুবই যুগোপযোগী হবে। যেমন—ছাত্রছাত্রীদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিটি কর্পোরেশন, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট অফিস ও আদালতে ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১ বছরকালীন ব্যবহারিক শিক্ষা হিসেবে কাজ করার ব্যবস্থা করা। এরকম ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের মনে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও গতিশীল বাস্তব জীবনের উপলব্ধি লাভ করতে পারবে। নারীশিক্ষার অগ্রগতির জন্য অধিকহারে নারী শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত গার্লস স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের সংবিধান অন্তর্ভুক্তি করা সময়ের দাবি। ছাত্রজীবনে সংবিধানের মতো একটি মহত্ অধ্যায় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন উচ্চশিক্ষা, কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবনে সফলতা এনে দিবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি শিক্ষিত জনগণেরই যেন সাংবিধানিক জ্ঞান থাকে, অজ্ঞতা দূরীকরণই দেশ ও জাতির উন্নয়নের মূলমন্ত্র। খসড়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আগে আমাদের পর্যাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা এবং অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধান করা অপরিহার্য। তা না হলে বিশৃঙ্খলা ছাড়া কিছুই আশা করা যাবে না। পাঠ্যকৃত সব ধর্মের ধর্মশিক্ষা বই আবশ্যকীয় বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সবাই সাধুবাদ জানাবে। পাঠ্যবই নির্বাচনে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মান নিশ্চিতকল্পে প্রতি মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে কিনা, শিক্ষার মান যাচাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিকেন্দ্রিকরণ করা দরকার। যাতে কয়েকটি স্কুলেই মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কেন্দ্রিকরণ না হয়। মসজিদ ও অন্য ধর্মশালায় ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আরও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ এখানে শুধু ধর্ম বিষয়ে শিক্ষার গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়গুলোর সঙ্গে অনেকাংশেই পার্থক্য রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়গুলো মসজিদ ও অন্য ধর্মশালায় শিক্ষা দিতে হলে পরিস্থিতি জটিল হবে। এসব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। মাদ্রাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সমুন্নত রেখেই শিক্ষানীতি তৈরি করা উচিত। বর্তমান সরকার জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা সবার দাবি। কিন্তু সংবিধানের মূলনীতি বাদ দিয়ে নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন হলে ধর্মপ্রাণ জনগণের অগ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি আবারও পরিবর্তন কিংবা বাতিলও হতে পারে। এতে আমাদের দেশের কমলমতি ছাত্রছাত্রীরা বিপাকে পড়বে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যস্রোতে চলতে দিন। গুটিকয়েক ভিনদেশি ভিন্ন ভাবধারার সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞের মন ও স্বার্থরক্ষা না করে ধর্মপ্রাণ মানুষের অধিকার রক্ষায় ব্রতী হয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করুন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বর্তমান ক্ষমতায়। এ দলটির এমন কিছু করা উচিত নয়, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতের বিপক্ষে চলে যায়।

No comments

Powered by Blogger.