পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হুঁশিয়ারি-প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের কঠিন পরিণতি হতে পারে

পাকিস্তানে সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে ‘গোপন চিঠি’ নিয়ে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। গোপন চিঠি কেলেঙ্কারি তদন্তে সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি ও আইএসআই-প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুজা পাশার আদালতে আবেদন করা বেআইনি হয়েছে—প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির এ মন্তব্যকে ‘সাংঘাতিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে সেনাবাহিনী। তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, এ ধরনের মন্তব্য দেশকে কঠিন পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।


অন্যদিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত প্রতিরক্ষাসচিবকে ‘বড় ধরনের অসদাচরণের’ দায়ে বরখাস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি, যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হুঁশিয়ারির পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশন বসছে।
গতকাল বুধবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেনাপ্রধান ও আইএসআই-প্রধানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন, তার চেয়ে বড় অভিযোগ আর কিছু হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রী এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন।’
সোমবার প্রধানমন্ত্রী গিলানি চীনের পিপলস ডেইলি অনলাইনকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে দুই শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা অসাংবিধানিক কাজ করেছেন। সেনাপ্রধান কায়ানির চীন সফরের সময়ই গিলানির ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে চীনা সংবাদপত্রটি।
গতকাল বুধবার এর তীব্র সমালোচনা করে সেনাবাহিনী ওই বিবৃতি দেয়। বিবৃতিটির ভাষা ছিল অস্বাভাবিক রকমের কঠোর। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য দেশের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলা হলেও তা কী হতে পারে, সে কথা সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে এতে বলা হয়, ‘সেনাপ্রধান যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেছেন। রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য এখন যেমন, তেমনি ভবিষ্যতেও হবে তাঁর প্রধান বিবেচনার বিষয়।’
এদিকে পাকিস্তান সরকারের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা জানান, ‘বড় ধরনের অসদাচরণের’ অভিযোগে প্রতিরক্ষাসচিব সাবেক জেনারেল নাইম খালিদ লোদীকে বরখাস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি’ করার দায়ে নাইম খালিদকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল লোদীর বরখাস্ত করার ঘটনা সরকারের সঙ্গে সেনা কর্মকর্তাদের বিরোধ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার রাতে ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতৃত্বাধীন জোটের নেতাদের বৈঠকে পার্লামেন্টের জরুরি অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। এর এক দিনের ব্যবধানে আজ অধিবেশন বসছে।
প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির দুর্নীতি মামলা পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাপারে আদালতের নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট দুজনকেই অযোগ্য ঘোষণা করে তাঁদের পদ বাতিল করা হবে—পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের এমন হুঁশিয়ারির পর মঙ্গলবার রাতে ক্ষমতাসীন জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জারদারি ও গিলানি। সেখানে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের জরুরি অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জারদারির মুখপাত্র ফারহাতুল্লাহ বাবর বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জরুরি অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে।’ তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে এ অধিবেশন শুরু হবে।
সুপ্রিম কোর্টের হুঁশিয়ারির পর করাচি সফর সংক্ষিপ্ত করে রাজধানী ইসলামাবাদে ফিরে আসেন প্রেসিডেন্ট জারদারি। এরপর কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেন তিনি।
এদিকে ক্ষমতাসীন জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি পদত্যাগ করতে চেয়েছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তা নাকচ করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের একজন মুখপাত্র।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন জোটের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জারদারি পদত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে গতকাল প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ফরহাতুল্লাহ বাবর এ খবরকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন।
দ্য ডেইলি নিউজ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বৈঠকে জারদারি জোট নেতাদের উদ্দেশে বলেন, তিনি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত। জোট চাইলে তিনি আগাম নির্বাচনের পদক্ষেপ নিতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট জারদারি আবারও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যাচ্ছেন—এমন খবরও প্রকাশ করা হয়েছে গণমাধ্যমে। পিপিপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এ খবরেরও সত্যতা নাকচ করে দিয়েছেন।
মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লেখা কথিত গোপন চিঠি নিয়ে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কয়েক মাস ধরে চরম দ্বন্দ্ব চলছে। গত অক্টোবরে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্যবসায়ী মনসুর ইজাজ ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এ লেখা এক নিবন্ধে লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি একটি গোপন চিঠি শীর্ষ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে তাঁকে (ইজাজ) দায়িত্ব দেন। সেই চিঠিতে প্রেসিডেন্ট জারদারি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিতে মার্কিন সহায়তা কামনা করেছেন। এতে আরও বলা হয়, ওই সেনা কর্মকর্তারা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করছেন। তবে চিঠিতে কারও নাম বা স্বাক্ষর ছিল না। এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় ও পার্লামেন্টারি তদন্ত কমিশন পৃথকভাবে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এএফপি, বিবিসি ও পিটিআই।

No comments

Powered by Blogger.