‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও গণহত্যার প্রতীক’
‘ইনি সেই গোলাম আযম, যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন; যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; যিনি আলবদর বাহিনী গড়ে তুলে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন।’
১৯৯২ সালে গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে ঠিক এভাবেই বলেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
১৯৯২ সালে গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে ঠিক এভাবেই বলেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি অভিযোগ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত মায়েদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বোনদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আলবদর কর্তৃক নিহত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি শত্রুর হাতে প্রাণদানকারী পিতামাতার অসহায় এতিম সন্তানদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে।’
৪০ বছর ধরে চলা এমন লাখো নির্যাতিতের অভিযোগেরই প্রাথমিক ফল পাওয়া গেল গতকাল বুধবার। মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার এক দিন পর তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৬২টি অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাতে গোলাম আযমকে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং ওই সময়ে সংঘটিত গণহত্যার প্রতীক। অভিযোগ অনুযায়ী, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযমের চেষ্টায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পাইওনিয়ার ফোর্স প্রভৃতি সহযোগী বাহিনী গঠন করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও সহযোগী বাহিনীগুলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সারা দেশে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছে, নেতা হিসেবে গোলাম আযম এসব অপরাধ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও নির্দেশদাতা। তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় উৎসাহ, প্ররোচনা ও উসকানি দিয়েছেন।
গোলাম আযমের বাংলাদেশ-বিরোধিতা কেবল ১৯৭১ সালেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্বাধীনতার পরেও তিনি তা চালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশকে কখনোই মেনে নেননি তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৯২ সালে এ নিয়ে বিশেষ অভিযোগও তুলেছিলেন। তিনি গণ-আদালতে বলেছিলেন, ‘গোলাম আজ সর্বদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন। বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে, স্মারকলিপি ও বিবৃতির দ্বারা, মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি নিজে এবং অপরের দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল ও সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার অসংখ্য নজির রয়েছে গোলাম আযমের কথাতেও। পুরো ১৯৭১ জুড়ে এ ধরনের তৎপরতার সংবাদ প্রতিদিন ছাপা হয় জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ। এমনকি আত্মজীবনীতেও গোলাম আযম লুকাননি নিজের মনোভাব। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম জীবনে যা দেখলাম। বইটির তৃতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সাফাই গেয়েছেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করার যুক্তি খুঁজেছেন, বর্ণনা করেছেন শান্তি কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপট। তাঁর দাবি, শান্তি কমিটির সঙ্গে জনগণের কোনো শত্রুতা ছিল না, মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই জনগণের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া গোলাম আযমের কাছে ‘পাকিস্তান বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষাদময় কাহিনি’। জীবনীর তৃতীয় খণ্ডের ‘১৬ ডিসেম্বরে আমার অনুভূতি’ অধ্যায়ে গোলাম আযম লেখেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে, তা ধারণা করিনি বলে মনের দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলাম না।’ তিনি সে সময়ে পাকিস্তানে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে পাকিস্তানে যান। এরপর তিনি আর দেশে ফেরেননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর অনুভূতি জানাতে গিয়ে মাসিক উর্দু ডাইজেস্ট-এর সম্পাদক আলতাফ হোসাইন কুরাইশীকে গোলাম আযম সে সময়ে বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম হিন্দু ও শিখ বাহিনীর নিকট প্রায় এক লাখ সদস্যের সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। ইংরেজ আমলেও মুজাহিদ বাহিনী শিখদের নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। তাঁরা শহীদ হয়েছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নানা অপকর্মের সহযোগী রাজাকার বাহিনীকে দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধকে নাশকতামূলক তৎপরতা উল্লেখ করে বইটির তৃতীয় খণ্ডে গোলাম আযম লেখেন, ‘যে রেযাকাররা (রাজাকার) দেশকে নাশকতামূলক তৎপরতা থেকে রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছে, তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা কি জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?’
গোলাম আযমের আরেক উদ্ভট দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হিংস্র হতে বাধ্য করেছেন। পাকিস্তানিদের পক্ষে তাঁর সাফাই, মুক্তিযোদ্ধারা অবাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করেছেন এবং এর প্রতিশোধ নিতেই পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের প্রতি নৃশংস হতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর আক্ষেপ, ‘মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির সঙ্গে শত্রুতা না করলে জনগণের পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতো না।’
গোলাম আযমের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা স্বাধীনতার পরও বজায় ছিল। পাকিস্তানে তিনি মাহমুদ আলী ও খাজা খায়েরউদ্দীনের সঙ্গে মিলে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল নিজেকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে পরিচয় দিতেন। ১৯৭২ সালে লন্ডনে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির এক বৈঠক করেন। সভায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভ্যন্তর থেকে কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। তারপর পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন তিনি।
পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আযম বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যাননি। গোটা আশির দশক ছিলেন জামায়াতের অঘোষিত আমির। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমির ঘোষণা করে জামায়াত।
এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। ১৯৯২ সালে নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন গণ-আদালত। সেই প্রতীকী গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগের প্রতিটিরই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য।
তবে সে সময়ের বিএনপি সরকার শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে ক্যানসারে ভুগে মারা যান। ওই বছরই গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
আজ জাহানারা ইমাম নেই। কিন্তু তাঁর ইচ্ছার কিছুটা হলেও পূরণ হলো গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে।
৪০ বছর ধরে চলা এমন লাখো নির্যাতিতের অভিযোগেরই প্রাথমিক ফল পাওয়া গেল গতকাল বুধবার। মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার এক দিন পর তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৬২টি অভিযোগ দাখিল করা হয়। তাতে গোলাম আযমকে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং ওই সময়ে সংঘটিত গণহত্যার প্রতীক। অভিযোগ অনুযায়ী, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযমের চেষ্টায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পাইওনিয়ার ফোর্স প্রভৃতি সহযোগী বাহিনী গঠন করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও সহযোগী বাহিনীগুলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সারা দেশে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছে, নেতা হিসেবে গোলাম আযম এসব অপরাধ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও নির্দেশদাতা। তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় উৎসাহ, প্ররোচনা ও উসকানি দিয়েছেন।
গোলাম আযমের বাংলাদেশ-বিরোধিতা কেবল ১৯৭১ সালেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্বাধীনতার পরেও তিনি তা চালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশকে কখনোই মেনে নেননি তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৯২ সালে এ নিয়ে বিশেষ অভিযোগও তুলেছিলেন। তিনি গণ-আদালতে বলেছিলেন, ‘গোলাম আজ সর্বদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন। বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে, স্মারকলিপি ও বিবৃতির দ্বারা, মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি নিজে এবং অপরের দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল ও সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার অসংখ্য নজির রয়েছে গোলাম আযমের কথাতেও। পুরো ১৯৭১ জুড়ে এ ধরনের তৎপরতার সংবাদ প্রতিদিন ছাপা হয় জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ। এমনকি আত্মজীবনীতেও গোলাম আযম লুকাননি নিজের মনোভাব। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম জীবনে যা দেখলাম। বইটির তৃতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সাফাই গেয়েছেন, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করার যুক্তি খুঁজেছেন, বর্ণনা করেছেন শান্তি কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপট। তাঁর দাবি, শান্তি কমিটির সঙ্গে জনগণের কোনো শত্রুতা ছিল না, মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই জনগণের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া গোলাম আযমের কাছে ‘পাকিস্তান বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষাদময় কাহিনি’। জীবনীর তৃতীয় খণ্ডের ‘১৬ ডিসেম্বরে আমার অনুভূতি’ অধ্যায়ে গোলাম আযম লেখেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে, তা ধারণা করিনি বলে মনের দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলাম না।’ তিনি সে সময়ে পাকিস্তানে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে পাকিস্তানে যান। এরপর তিনি আর দেশে ফেরেননি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর অনুভূতি জানাতে গিয়ে মাসিক উর্দু ডাইজেস্ট-এর সম্পাদক আলতাফ হোসাইন কুরাইশীকে গোলাম আযম সে সময়ে বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম হিন্দু ও শিখ বাহিনীর নিকট প্রায় এক লাখ সদস্যের সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। ইংরেজ আমলেও মুজাহিদ বাহিনী শিখদের নিকট আত্মসমর্পণ করেননি। তাঁরা শহীদ হয়েছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নানা অপকর্মের সহযোগী রাজাকার বাহিনীকে দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধকে নাশকতামূলক তৎপরতা উল্লেখ করে বইটির তৃতীয় খণ্ডে গোলাম আযম লেখেন, ‘যে রেযাকাররা (রাজাকার) দেশকে নাশকতামূলক তৎপরতা থেকে রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছে, তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা কি জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?’
গোলাম আযমের আরেক উদ্ভট দাবি, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হিংস্র হতে বাধ্য করেছেন। পাকিস্তানিদের পক্ষে তাঁর সাফাই, মুক্তিযোদ্ধারা অবাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করেছেন এবং এর প্রতিশোধ নিতেই পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের প্রতি নৃশংস হতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর আক্ষেপ, ‘মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির সঙ্গে শত্রুতা না করলে জনগণের পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতো না।’
গোলাম আযমের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা স্বাধীনতার পরও বজায় ছিল। পাকিস্তানে তিনি মাহমুদ আলী ও খাজা খায়েরউদ্দীনের সঙ্গে মিলে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল নিজেকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে পরিচয় দিতেন। ১৯৭২ সালে লন্ডনে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির এক বৈঠক করেন। সভায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভ্যন্তর থেকে কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। তারপর পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন তিনি।
পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আযম বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যাননি। গোটা আশির দশক ছিলেন জামায়াতের অঘোষিত আমির। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমির ঘোষণা করে জামায়াত।
এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। ১৯৯২ সালে নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন গণ-আদালত। সেই প্রতীকী গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগের প্রতিটিরই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য।
তবে সে সময়ের বিএনপি সরকার শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে ক্যানসারে ভুগে মারা যান। ওই বছরই গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
আজ জাহানারা ইমাম নেই। কিন্তু তাঁর ইচ্ছার কিছুটা হলেও পূরণ হলো গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে।
No comments