গফরগাঁওয়ের রাজাকার ফজলুর রহমান সুলতান by আবু সালেহ রনি

কাত্তরে ময়মনসিংহে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর-রাজাকার ও শান্তি কমিটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বর্তমানে চারদলীয় জোট সমর্থক ফজলুর রহমান সুলতান। তার নির্দেশেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ সহযোগী অন্যান্য বাহিনীর সহায়তায় গফরগাঁও থানার চরআলগি ইউনিয়নের ৪২ জনকে হত্যা এবং এক দিনে ওই এলাকার ১ হাজার ৪০০ ঘরে লুটপাট শেষে অগি্নসংযোগ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুলতানের বিরুদ্ধে করা একটি মামলা


বর্তমানে তদন্তাধীন পর্যায়ে আছে।\প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা ও ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, রাজাকার সুলতান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু অগি্নসংযোগ ও হত্যাতেই ক্ষান্ত ছিলেন না, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে হত্যার আগে পুরনো হাসপাতাল ও লঞ্চঘাটে ধরে এনে বেয়নেট দিয়ে নির্যাতন করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পরপরই ফজলুর রহমান সুলতান যোগ দেন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। হত্যা, লুট ও নারীদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর সুলতান রাজাকারের বিচার চেয়েছেন এলাকাবাসী। গত নভেম্বরেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুলতান রাজাকারসহ গফরগাঁওয়ের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে। এর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধে গফরগাঁওয়ের দোয়েলপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী মাস্টারকে হত্যার অভিযোগে ২০০৯ সালের ২৫ এপ্রিল স্থানীয় থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলা নম্বর-২৩। মামলার বাদী আবু খালিদ এজাহারে বলেন, সুলতান রাজাকারসহ ১৪-১৫ জন একাত্তরে তার বাবা মোহাম্মদ আলী মাস্টারকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করেন। জানা যায়, বর্তমানে এ মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্তাধীন পর্যায়ে আছে।
গফরগাঁও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইকবাল-ই-আলম কামাল সমকালকে বলেন, স্থানীয় জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। তারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী সুলতান রাজাকারের বিচার চান। ক্ষতিগ্রস্ত চরআলগি ইউনিয়নের স্বজন হারানো পরিবারগুলো এখনও ভুলতে পারেনি একাত্তরের বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর কথা।
একাত্তরে ফজলুর রহমান সুলতানের ভূমিকা প্রসঙ্গে গফরগাঁও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও প্রত্যক্ষদর্শী মফিজ আহমদ সমকালকে বলেন, গফরগাঁওয়ে হাসমতউল্লাহ ছিলেন রাজাকারদের নেতা। এ রাজাকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন ফজলুর রহমান সুলতান। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের টিকিটে নির্বাচন করতে না পেরে স্ব্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একাত্তরের ২৫ মার্চের বহু আগে থেকেই ফজলুর রহমান সুলতান স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সুলতান প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনীতিক হিসেবে পাক বাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে যান। তার নির্দেশেই একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এক দিনে গফরগাঁও উপজেলার চরআলগি ইউনিয়নের চরমোছলন্দ গ্রামে ১ হাজার ৪শ'র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা। তিনি আরও বলেন, শুধু অগি্নসংযোগের মধ্যেই ক্ষান্ত থাকেননি সুলতান রাজাকার ও তার বাহিনী। তার দেখানো মতো ওই ইউনিয়নের আমির আলী মাস্টার, কুদ্দুস মাস্টার, আবদুল কুদ্দুস মাস্টার ও তার ছেলেসহ ৪২ জনকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধা মফিজ জানান, স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিরা এ সময় প্রাণভয়ে মসজিদে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পাননি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে। প্রতিদিন পুরনো হাসপাতাল ও লঞ্চঘাটে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো।
গফরগাঁও উপজেলার চরআলগি গ্রামের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সমকালকে জানান, একাত্তরে অক্টোবরের শেষ দিকে এলাকায় বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে সমরশিক্ষা শেষে গফরগাঁওয়ের উত্তর দিকে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। সেখান থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনী ও সহযোগী অন্যান্য বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতেন। নভেম্বরে সুলতানসহ পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা চরআলগি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে নদী পার হওয়ার সময় মুুক্তিযোদ্ধাদের বাধার মুখে পড়ে। কিন্তু এ সময় চরআলগি ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও রাজাকার সফিজউদ্দিন ফরাজী এবং তার বড় ছেলে নূর ইসলাম বাবুল পাক সেনাবাহিনী ও সুলতানসহ অন্যদের নৌকাপথে অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের শেষ দিকে সুলতানের ষোলহাসিয়া গ্রামের বাড়িঘরে আক্রমণ চালান; কিন্তু স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তারকারী রাজাকার সুলতান এ ঘটনাকে পুঁজি করে পরে মুুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করেন।
মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সমকালকে জানান, গফরগাঁওয়ের চরআলগি গ্রামে এ ঘাতকের সহায়তায় একই দিনে ১ হাজার ৪০০ ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ভয়াবহ অগি্নসংযোগে ফজলুর রহমান সুলতান সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডগুলো হানাদার বাহিনীসহ অন্যরা করলেও নির্দেশদাতা হিসেবে সব দায় সুলতান রাজাকারের। তার মতে, হানাদার বাহিনী গফরগাঁওয়ের কোন গ্রামে কোন বাড়িতে সুন্দরী নারী বা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক আছে তা জানত না। সুলতান রাজাকারসহ তার সহযোগীরাই সেসব চিনিয়ে দিয়েছিলেন হানাদার বাহিনীকে। এ জন্য অবশ্যই সুলতান রাজাকারের বিচার হওয়া উচিত।
গফরগাঁওয়ের ওপর রচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সূত্র ও রাজাকার ইনফো নামে একটি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ফজলুর রহমান সুলতান ১৯৭০ সালে গফরগাঁও এলাকার বারোবাড়ি ইউনিয়নে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিলে স্থানীয় জনতা তাকে বহনকারী জিপটি পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনার জের ধরে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা ঠুকে দেন। এতে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সামরিক আদালতে তার এক বছরের জেল হয়। মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম তখন গফরগাঁও কলেজের ভিপি ছিলেন। এ কারণে আন্দোলনের প্রবল চাপের মুখে ইয়াহিয়া খান তৎকালীন রাজবন্দিদের সঙ্গে তাকেও মুক্তি দিয়েছিল। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে ওই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে সুলতান রাজাকার তার বাড়ি পুড়িয়ে দেন। তিনি জানান, শুধু তার বাড়ি নয়, আলাল আহমেদ, খসরু চেয়ারম্যান ও আরফান চেয়ারম্যানের বাড়িও পুড়িয়ে দেন রাজাকার সুলতান। স্বাধীনতা যুদ্ধের এ বীর যোদ্ধার একটাই দাবি, এসব রাজাকার-ঘাতককে যেন বাংলার মানুষ রুখে দেয়। (সূত্র : বাংলাদেশ সাপ্তাহিক : ১ বর্ষ সংখ্যা-৩২)
রাজনীতি : ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও উপজেলা) আসন থেকে বিএনপি সমর্থিত চারদলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ফজলুর রহমান সুলতান গত নবম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে ওই নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সোচ্চার দেশের অন্যান্য আসনের মতো গফরগাঁওয়ের জনগণও তাকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এর আগে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ফজলুর রহমান সুলতান বিএনপি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর কয়েক দফা গফরগাঁওয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেও সাড়া দেননি এলাকাবাসী। দলে এখন তার পরিচয় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি।
ফজলুর রহমান সুলতানের বক্তব্য : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে গতকাল শনিবার ফজলুর রহমান সুলতান সমকালকে বলেন, 'অভিযোগ ডাহা মিথ্যা।' তিনি জানান, একাত্তরের এপ্রিলে যেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গফরগাঁওয়ে প্রবেশ করেছিল সেদিন তিনি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক হীনম্মন্যতার কারণে তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.