আলোকবর্তিকা বেগম রোকেয়া by অদিতি রহমান

হারানী বাল্যকাল হইতেই বিজ্ঞানচর্চা করিতে ভালোবাসিতেন। সাধারণ রাজকন্যাদের ন্যায় তিনি বৃথা সময় যাপন করিতেন না। একদিন তাহার খেয়াল হইল যে, তাহার রাজ্যের সমুদয় স্ত্রীলোকই সুশিক্ষাপ্রাপ্ত হউক। মহারানীর খেয়াল, সে খেয়াল তৎক্ষণাৎ কার্যে পরিণত হইল! অচিরেই গভর্নমেন্ট পক্ষ হইতে অসংখ্য বালিকা স্কুল স্থাপিত হইল। এমনকি পল্লী গ্রামেও উচ্চশিক্ষার অমিয় স্রোত প্রবাহিত হইল। শিক্ষার বিমল জ্যোতিতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার তিরোহিত হইতে লাগিল এবং বাল্যবিবাহ প্রথাও রহিত হইল। একুশ বছর বয়ঃক্রমের পূর্বে কোনো কন্যার বিবাহ হইতে পারিবে না_ এই আইন হইল।'
'সুলতানার স্বপ্ন' গল্পে নারীস্থানের নারীরা এমন রাজ্যেই বাস করতেন। যে রাজ্যে নামে শিক্ষা নয়, সত্যিকারের শিক্ষার আলোকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। সে রাজ্যে শাসক-প্রজা সবাই ছিল নারী। পুরুষ জাতির অস্তিত্ব ছিল। তবে তারা ছিল অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ অবস্থায়। কারণ শারীরিকভাবে তারা শক্তিশালী হলেও নারীর মস্তিষ্ক ছিল অনেক বেশি উন্নত। সে রাজ্যের নারীরা মনে করত, স্ত্রী লোকের মস্তিষ্ক পুরুষের চেয়ে শক্তিশালী, ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা। নারী ১০ বছরে যা করতে পারে, পুরুষ শতবর্ষে তা করতে পারে না। শুধু কথা বা ভাবনায় নয়; প্রজ্ঞা, মেধা আর পরিশ্রমের সমন্বয়ে নারীস্থানকে আধুনিক এক নগরে পরিণত করেছিল তারা। আজ নারীস্থানের মতো এমন স্বর্গরাজ্যের বাস্তবচিত্র না পাওয়া গেলেও সোয়াশ' বছর আগে বাস্তব অর্থে এমন রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন নারী, তাও আবার বাঙালি মুসলিম নারী_ তা ভেবে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। সময় থেকে কতটা অগ্রসর হলে এমন স্বপ্ন দেখা সম্ভব। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম না হলে বোধকরি তা চিন্তার উপলব্ধির বাইরে থেকে যেত। ভেবে আশ্চর্য হতে হয়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন নারী ছিল পর্দার আড়ালে অবরোধবাসিনী, তখন তিনি কী করে 'সুলতানার স্বপ্ন' নামের রূপক গল্পটিতে এমন নারী রাজ্যের কথা লিখেছিলেন। যে রাজ্যে পুরুষ পর্দার আড়ালে গৃহকোণে আবদ্ধ আর নারীরা এক অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রকৃতিকে বশীভূত করে আশ্চর্য শৃঙ্খলার সঙ্গে সব কাজ চালাচ্ছে। নারীত্বের প্রতি তার আদর্শ কত উঁচু ছিল, নারীর শক্তির প্রতি তার কতটা বিশ্বাস ছিল, তার মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও আজ তা আমরা পলে পলে উপলব্ধি করতে পারি। বাঙালি মুসলিম নারীর ভাগ্যাকাশে সূর্যের আলো হয়ে এসেছিলেন তিনি। যে আলোকবর্তিকায় নিকষ অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসার পথ পেয়েছিল নারী। অসামান্য এ নারী রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে একটি প্রজন্মকে নারী নয়, মানুষ হিসেবে জাগিয়ে তুলেছিলেন। সে প্রজন্মের পথ ধরে নারী এগিয়েছে এবং আজকের অবস্থানে পেঁৗছেছে। অত্যন্ত দূরদর্শী রোকেয়া অনুধাবন করতে পেরেছিলেন শিক্ষা ছাড়া নারী তার অধিকার, সম্মান, সমমর্যাদা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র_ কোথাও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। তার জীবনের অভিজ্ঞতায় এবং অন্তর্নিহিত প্রতিভার দীপ্তিতে তিনি এই সত্যি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কাজেই জনসংখ্যার অর্ধগোষ্ঠী নারীকে অন্ধকারে রেখে জাতির উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ উপলব্ধিতে মুসলমান নারী সমাজের জাগরণের জন্য শিক্ষা প্রচার আন্দোলনের ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। অথচ তিনি নিজে কোনো ডিগ্রিধারী শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। এমন এক পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন, যেখানে পাঁচ বছর বয়স থেকে অপরিচিত মহিলাদের সামনেও পর্দা পালন করতে হতো। সে পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা নেওয়া বিশেষ করে বাংলা এবং ইংরেজি_ তা ছিল পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এমন পরিবেশে বড় বোন করিমুন্নেসার কাছ থেকে রোকেয়া খানিকটা বাংলা শিখেছিলেন। বড় ভাই ইবরাহিম তাকে লেখাপড়ায় উৎসাহ দিয়েছিলেন। তবে তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন তার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং প্রগতিশীল ব্যক্তি। দোজবর এবং পৌঢ় হলেও স্বামী সাখাওয়াত হোসেন লেখাপড়ার বিষয়ে রোকেয়াকে উৎসাহ দিতেন বরাবরই। স্বামীর সহযোগিতায় রোকেয়া ধীরে ধীরে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলেন। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। সমাজমনস্ক রোকেয়ার স্বামী সবসময় নারীশিক্ষার কথা বলতেন। নারীদের শিক্ষার উন্নতির জন্য তিনি স্ত্রীকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন এবং স্ত্রী রোকেয়াকে তার সম্পত্তির ট্রাস্টি করে যান। মাত্র ২৯ বছর বয়সে রোকেয়া বিধবা হন। প্রয়াত স্বামীর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য, সেই সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রসারে আন্তরিক ইচ্ছায় স্বামীর মৃত্যুর ৫ মাস পর ভাগলপুরে মুসলিম মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর মাত্র ৫ জন মেয়ে নিয়ে শুরু হয় স্কুলের যাত্রা। পরে ১৯১১ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় গড়ে তোলেন 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। এই স্কুল বাঙালি মুসলিম নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে মাইলফলক, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, যা চিন্তা করতেন বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতেন না, কাজের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটাতেন। এখানেই তার সততা ও মহত্ত্ব নিহিত।
'আমি আজীবন নারী জাতির কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করিব এবং অবরোধ প্রথার মূলোচ্ছেদ করিব ... আমি সমাজকে দেখাইয়া দিতে চাই একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের চরম লক্ষ্য নহে, সংসার ধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে।' 'পদ্মরাগ' উপন্যাসে নায়িকা সিদ্দিকার এ উক্তির মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া নারীর আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি নারীর জীবনকে মানবিক ভিত্তির ওপর স্বাবলম্বী করে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, উপার্জনক্ষম নারীই যথার্থ স্বাধীন। সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার একমাত্র উপায় তার অর্থনৈতিক ক্ষমতা। আর এ ক্ষমতা অর্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা অর্জন। একমাত্র শিক্ষাই পারে মানুষের জীবন পুরোপুরি বদলে দিতে। তার এই উপলব্ধি তিনি তার জীবদ্দশায় ছড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তার চেষ্টা বৃথা যায়নি জোর দিয়ে তা বলতে পারি। যদিও আজকের আধুনিক সময়ে বহু নারী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত আমাদের দেশে। কিন্তু তারপরও নারীশিক্ষার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। একটা ভালো অবস্থানে পেঁৗছেছে এ দেশের নারী। শিক্ষা ছাড়া জীবন অন্ধকার, এই বোধটুকু জেগেছে এখন নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই।

No comments

Powered by Blogger.