এই ভূখণ্ডের অধিকার তারা কাকে দিতে চায়

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী অসামান্য সাহসী এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। একজন শুদ্ধ আত্মার মানুষের নাম। সত্যিকারের প্রগতিশীল এক ব্যক্তিত্বের নাম। যিনি যুদ্ধকালীন সাড়ে সাতটি মাস নারকীয় নির্যাতন ভোগ করেছেন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সময় অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বলেছেন এ দেশের ৪ লাখ মা-বোনের মতো আমিও পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত-নিপীড়িত। বলতে এতটুকু দ্বিধা হয়নি তার।
কারণ দেশের স্বাধীনতার জন্য তার ওপর পাশবিক অত্যাচারকে তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরাট ত্যাগ বলে মনে করেন। যুদ্ধের শুরুটা তার জীবনের শুরু থেকেই। বাবাকে হারান অল্প বয়সে। বাবা শখ করে এমন সুন্দর নাম রেখেছিলেন মেয়ের। মেয়ে তার মর্যাদা রেখেছেন যথাযথভাবে। বর্তমানে দেশের একজন নামকরা ভাস্কর্যশিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। যখন তার বয়স ১৬ তখন তিনি একজন চিত্রশিল্পীকে স্বামী হিসেবে বেছে নেন। স্বামীর কর্মসূত্রে খুলনার খালিশপুরে পিপলস জুট মিলের বাসায় সংসার জীবন শুরু তার। স্বামী তার লেখাপড়ার দায়িত্বও নেন। কিন্তু তিনটি সন্তান জন্মের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। তখন তার বয়স ২৪। সে সময় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। তিন সন্তান, ছোট ভাই-বোন এবং মায়ের দায়িত্ব বহন করতে ক্রিসেন্ট জুট মিলে জয়েন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের কেবল শুরু তখন। বললেন, আমরা ভাবতেই পারছিলাম না সামনের দিনগুলোতে কত ভয়াবহতা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। পুরো খালিশপুরে যুদ্ধের শুরুতে বিহারিদের নিষ্ঠুরতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও আমি অন্যদের মতো এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারলাম না। কারণ তখন ছয়জন মানুষের দায়িত্বভার আমার কাঁধে। তখনও কাজ করছেন তিনি। কিন্তু দ্রুতই স্থানীয় রাজাকারদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়েন তিনি। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেখানকার পাকিস্তানি সেনারা তাকে বন্দি করে। দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস তিনি বর্বর পাকিস্তানি অফিসার, সেনা এবং স্থানীয় রাজাকার দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচজন লোক তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। এই নির্যাতন ভোগের পরও বুকে আশার আলো জেগে উঠত দেশ স্বাধীন হতে আর বেশি দেরি নেই। কারণ তার মতো আরও লাখ লাখ মা-বোন যে এই নির্যাতন সইছে দেশের স্বাধীনতার জন্য। তাদের শারীরিক, মানসিক এই কষ্ট কখনও বৃথা যেতে পারে না। বাঙালি জাতিও তাদের এই ত্যাগকে যথাযথ মূল্যায়ন করে। স্বাধীনতা-পররর্তী সরকার তাদের অবদানকে মূল্যায়ন করে বিজয় বীর অর্থাৎ বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করে। বললেন, যশোর ক্যান্টনমেন্টে বন্দিদশায় রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কীভাবে যে পার হতো বলতে পারব না। চারদিকে কেবল খুঁজতাম কোনো একজন বন্ধুর সহযোগিতার হাত পাই কি-না। অন্তরের চাওয়া বোধ হয় সত্যি সত্যি পূরণ হয়। সেই দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্ধুত্বের সহযোগিতার হাত বাড়ালেন এ টি আহমেদুল্লাহ আহমেদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই মানুষটি তার বাকি জীবনের দায়িত্ব বহন করেন স্বামী হিসেবে। কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি সব দুঃখ কিংবা কষ্ট। বরং তা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল যখন তিনি তার পুরনো কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে চাইলেন। তার সহকর্মীরা তাকে নানা অপবাদ দিল। হাস্যরসের কৌতুকে পরিণত করল তাকে। তাদের নিম্নস্তরের এই আচরণের সঙ্গে যোগ দিল তার ননদও। স্বামী বঞ্চিত হলেন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে। কিন্তু স্বামী আহমেদুল্লাহর অহঙ্কার, তিনি একজন বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করেছেন। ভালোবাসা আর গর্বে আগলে রেখেছেন তাকে।
বিজয়ী এই নারীর কাছে প্রশ্ন ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম নিয়ে। উত্তরে বলেন, দ্রুত বিচার কার্য সম্পন্ন হোক, এটা আমি চাই। কারণ বিচার যত দেরি হবে দেশে অরাজকতা ততই বাড়তে থাকবে। স্বাধীনতা বিপক্ষ শক্তি সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে তারা কিছুই করতে পারবে না, এটা আমার বিশ্বাস। কারণ মুষ্টিমেয় কিছু চিহ্নিত লোক ছাড়া এ দেশের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পক্ষের সব মানুষকে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে, দলবদ্ধ হতে হবে।
বর্তমান সরকার বিচার কাজ শুরু করেছে, কাজেই এখন যুদ্ধটা পক্ষশক্তি আর বিপক্ষ অপশক্তির মুখোমুখি যুদ্ধ। তাই আমাদের সবার সজাগ থাকা প্রয়োজন।
বললেন, আমি ভেবে পাই না বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কীভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ অবলম্বন করেন? খালেদা জিয়া তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন, তাহলে তিনি কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেন? তিনি তাদের পক্ষে কথা বলার সাহস পান কোথা থেকে? তাহলে বলতে হবে তিনি জানেনই না মুক্তিযুদ্ধ কী? স্বাধীন এই ভূখণ্ডের অধিকার তিনি কাকে দিতে চান? স্বাধীন ভূখণ্ড এবং দেশের মানচিত্র বলতে তিনি কী বোঝেন? তার দেশবিরোধিতার পক্ষে জনগণ আছে, এটা যদি ভাবেন তাহলে তিনি ভুল করবেন। রাজনৈতিক দলের ঐতিহ্য থাকতে হয়। তাকে রাজনীতি করতে হলে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির কাছাকাছি থাকতে হবে। সমর্থন দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.