রঙ্গব্যঙ্গ-হাসিনা-খালেদার কাল্পনিক বৈঠক by মোস্তফা কামাল

দেশে আবার ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির নানামুখী তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক সরকারকে ব্যর্থ করে দেশে একটি অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি মহল বেশ সক্রিয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের যোগসাজশে অশুভ চক্রটি দুই নেত্রীর বিরোধকে পুঁজি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর বৈঠক খুবই জরুরি। আমরা সবাই জানি, তাঁদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক আদৌ সম্ভব নয়। তাই আমরা দুই নেত্রীর বৈঠক কল্পনা করতে পারি।


ধরুন, শেখ হাসিনা একদিন সকালে খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে হাজির হলেন। খালেদা জিয়া লংমার্চে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সবে সামনের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠল। কাজের লোকদের একজন দরজা খুলে দিল। শেখ হাসিনা দ্রুত পা ফেলে ঘরে ঢুকলেন। খালেদা জিয়া বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ। তারপর শেখ হাসিনার সামনে এগিয়ে এসে বললেন, আরে আপনি!
শেখ হাসিনা বললেন, অবাক হলেন মনে হয়?
হুম, অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা!
মানে!
আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে। আসার সময় সাংবাদিকদের জানিয়ে এসেছেন নাকি!
কেন, কোনো অসুবিধা আছে?
হ্যাঁ, মিডিয়া সারা দিন প্রচার করবে, বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী!
তাতে অসুবিধা কী?
অসুবিধা হচ্ছে, আপনি আমার চেয়ে এগিয়ে গেলেন। আসলে তো আমার যাওয়া উচিত ছিল আপনার কাছে। এটাই রীতি।
রাখেন ওসব রীতিফিতি! শোনেন, ঘটনা তো খুব খারাপ!
কোন ঘটনা বলুন তো!
শেখ হাসিনা বললেন, আমাদের দুজনকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমরা নাকি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছি। একবার আপনি, আরেকবার আমি ক্ষমতায় যাচ্ছি। এটা কারো সহ্য হচ্ছে না। তাই বলা হচ্ছে, আমাদের কাছে নাকি বাংলাদেশ জিম্মি।
খালেদা জিয়া কথা টেনে নিয়ে বললেন, এই ষড়যন্ত্রকারীরাই তো আমাদের জিম্মি করেছিল। ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি করে আমাদের মাইনাস করতে চেয়েছিল। জেলেও নিয়েছিল। রাখতে পেরেছে?
পারবে কিভাবে? আমাদের পেছনে তো জনগণ আছে। আর তাই আমাদের মাইনাস করতে গিয়ে নিজেরাই মাইনাস হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা বললেন।
খালেদা জিয়া বললেন, আপনার ওই কথাটা খুব ভালো লাগছে।
কোন কথাটা? শেখ হাসিনা প্রশ্ন করলেন।
আপনি বললেন না, কিছু বুদ্ধিজীবীর ক্ষমতায় যাওয়ার সাধ আছে। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে তো জনসমর্থন লাগে। সেটা তাদের নেই বলে তারা অগণতান্ত্রিক পন্থা বেছে নিতে চায়।
হুম, এসব বলি বলে আমাকে সবাই ঠোঁটকাটা বলে।
আপনি ভুল কী বলেছেন? সবই তো সত্যি। আসলে আমাদের মাইনাস করার জন্য সবাই যেন একাট্টা। এ পরিস্থিতিতে কী করা যায় বলুন তো! খালেদা জিয়া জানতে চাইলেন।
শেখ হাসিনা বললেন, আমাদের ঝগড়া-বিবাদ বন্ধ করে আসুন, আমরা মিলে যাই। তবে একটা শর্ত আছে।
'কি শর্ত বলুন তো?'
'শর্তের কথা পরে বলব, আগে বলুন, আমার প্রস্তাবে আপনি কি সম্মত?'
'প্রস্তাবটা তো শুভ। কিন্তু আমাদের কি মিলতে দেবে?'
'এই তো! আসল কথাটা বেরিয়ে গেল! আমরা তো মিলেমিশেই কাজ করতে চাই। কিন্তু আমাদের মিলতে দেওয়া হয় না। আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য একটি অশুভ শক্তি সব সময় সক্রিয় থাকে। কী বলেন, কথা ঠিক না?'
'জি, ঠিক। একদম ঠিক! আচ্ছা, আপনি কী যেন শর্তের কথা বললেন!'
'সে কথা পরে হবে। আগে বলুন, শত বাধা সত্ত্বেও আমরা মিলেমিশে কাজ করব। আপনি রাজি তো?'
'রাজি, তবে একটা কথা!'
'কী কথা?'
'আমি যখন সরকারে থাকব, আপনি কোনো ডিস্টার্ব করবেন না। আবার আপনি যখন ক্ষমতায় থাকবেন আমিও কোনো ডিস্টার্ব করব না। এই শর্তে রাজি?'
'রাজি না হয়ে উপায় কী? এখন আমাদের বাঁচামরার প্রশ্ন। যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে আপনার-আমার ঐক্য ছাড়া বিকল্প নেই।'
'এত দিনে একটা খাঁটি কথা বললেন। এবার আপনার শর্তের কথা বলুন।'
'আপনাকে অবশ্যই ওই স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এই শর্তে আপনি রাজি?'
'রাজি। তবে আমার দুটি শর্ত আছে।'
'বলুন, শর্ত দুটি কী?'
'আপনাকে স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।'
'ওকে। আরেকটা শর্ত?'
'আমার দুই ছেলের বিরুদ্ধে সব ধরনের অভিযোগ তুলে নিতে হবে।'
'আপনার প্রথম শর্তটি মানতে কোনো আপত্তি নেই। দ্বিতীয় শর্তটি মানতে আপত্তি আছে।'
'কী আপত্তি?'
'আসলে আপত্তি নয়, শর্তটি পূরণ করার ক্ষমতা আমার নেই।'
'ক্ষমতা তাহলে কার হাতে! আপনিই তো বারবার ওদের দুর্নীতির বরপুত্র বলে তিরস্কার করেন! আপনার ছেলে কম্পিউটার বিজ্ঞানী হতে পারে; কিন্তু কোনো দিন রাষ্ট্রনায়ক হতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। আর আমার ছেলে কিন্তু এ দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী!'
'তাই নাকি! সেই খুশিতেই বুঝি আপনি টগবগ করছেন! সে আশায় গুড়ে বালি। ওসব আজগুবি চিন্তা করছেন বলেই তো আবার ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।'
'আচ্ছা থাক, ওসব চিন্তা বাদ! দয়া করে আমার ছেলেদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিন। দেখুন, ওরা তো আমার ছেলে নাকি! অথচ ওরা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে! ওদের জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগে জানেন!'
'জানি। কিন্তু কী করব বলুন! ওদের ব্যাপারটা তো আমার হাতে নেই! আপনাকে সব কিছু খুলে বলতে পারছি না।'
'ব্যাপারটা যাদের হাতে, তাদের সঙ্গে কথা বলুন। তা না হলে তো মিলতে পারব না।'
'না মিললে তো ওয়ান-ইলেভেন আবার আসবে। আবার জেলজুলুম, মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আপনি এই বুড়ো বয়সে আবার জেলে যেতে চান?'
'না, না! আর জেলজুলুম নয়। আসুন আমরা বরং মিলেই যাই! আমাদের মধ্যে মিল থাকলে ক্ষমতা আর নেয় কে? একবার আমি, আরেকবার আপনি! হা হা হা!'
শেখ হাসিনাও তাঁর সঙ্গে হেসে উঠলেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.