গ্লাডিয়েটর by অন্তরীপ রায়

য়্যাম এ টায়ার্ড ওল্ড ম্যান নাও_ ২১৯ রানের মহাকাব্য গড়ার পর বলেছেন বিরেন্দর শেবাগ। সত্যি চমকে দেওয়ার মতো। শেবাগ নিজেকে বলছেন 'ওল্ড ম্যান'। তাও ইন্দোরের প্রলয়ঙ্কর ব্যাটিংয়ের পর। আচমকা মনে পড়ল অন্য এক ওল্ড ম্যানের গল্প। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বৃদ্ধ নাবিক। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে যিনি জীবন-মরণের সীমানা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।


তুফান, মৃত্যু আর চূড়ান্ত নৈরাশ্যের মুখে দাঁড়িয়ে তার ঘোষণা ছিল_ ম্যান ক্যান ডেস্ট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড। বাস্তবের শেবাগ যদিও সে রকম কোনো যুদ্ধ জেতেননি; কিন্তু ক্রিকেট ভুবনে এক অসাধ্য সাধন করেছেন। খুব অনায়াস ভঙ্গিতে। 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য শি'র সিংহহৃদয় বৃদ্ধ নাবিকটির মতোই। কী এমন করেছেন শেবাগ ? গল্পটা তাহলে বলা যাক...
গোয়ালিয়র থেকে ইন্দোরের দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটার। ব্যবধান মুছে মধ্যপ্রদেশের দুই শহর ক্রিকেট ইতিহাসের এক বিন্দুতে মিলে গেছে। দুটি মাঠ এখন ডাবল সেঞ্চুরির ধাত্রীভূমি। গোয়ালিয়রে ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। ইন্দোরে সেই গৌরব মুছে নতুন ইতিহাস গড়লেন বিরেন্দর শেবাগ। সাধে কি আর সঞ্জয় মাঞ্জরেকার লিখেছেন_ 'পিচ দুটি এখন দ্রষ্টব্যস্থান হিসেবে দেখাতে পারে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম'। প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পেতে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৪০ বছর। দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরির দেখা মিলল দুই বছরের ব্যবধানে। অনবদ্য ভঙ্গিমায় তা করে দেখালেন বিরেন্দর শেবাগ। যিনি ক্রিকেটে 'কল্লোল যুগের' প্রতিভূ।
প্রায় ঘোষণার মতোই ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন নজফরগড়ের নবাব। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে সম্ভাবনা জাগিয়েও সফল হননি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৭৫ রানে তাণ্ডব থেমে গিয়েছিল। এরপর ইনজুরি আর পড়তি ফর্মের আলো-আঁধারিতে শেবাগ নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। সমালোচকরা বলতে শুরু করে শেবাগ এখন নিভে যাওয়া ভলকানো। ইন্দোরে আচমকা যার ঘুম ভেঙে গেল। ফলে রানের লাভাস্রোতে ঢাকা পড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই ধ্বংসাত্মক ব্যাটিংয়ের সঠিক উপমা কী হতে পারে। তুফান? না। বিস্ফোরক? তা-ও নয়। সবুজ করিডোরে সচল আগ্নেয়গিরি বললেই বোধহয় শেবাগের বিপুল ধ্বংসোন্মাদনাকে ঠিক বোঝানো যায়। ইন্দোরে যখন স্ফুলিঙ্গের মতো বাউন্ডারির স্রোত বেরিয়ে আসছিল তার ব্যাট থেকে তখন শেবাগকে মনে হচ্ছিল স্রেফ একটা জ্বালামুখ।
রোচের প্রথম ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে শুরু করেছিলেন। পরের বলে রামপালকে বাউন্ডারি মেরে গতিময় হলেন। ক্রমশ সময় গড়িয়েছে আর ক্ষুরধার হয়েছে শেবাগের ব্যাট। শর্ট অব গুডলেংথ থেকে বল তুলেছেন রোচ, মুহূর্তে শেবাগ চলে গেছেন পেছনের পায়ে। বল কাভার দিয়ে খুঁজে নিয়েছে বাউন্ডারির সীমানা। রামপালের গুডলেংথকে হাফভলি করে নিয়েছেন। শর্ট পিচ হয়ে গেছে ফুলটস। শেষ পর্যন্ত ২৫টি বাউন্ডারি আর ৭ ওভার বাউন্ডারিতে যখন থামলেন তখন নামের পাশে ২১৯ রানের কীর্তিস্তম্ভ। ইনিংসটি দেখার পর যুবরাজ সিং টুইটারে লিখেছেন_ 'আমি আবার বলছি। কোনো দিন স্যার ভিভকে ব্যাট করতে দেখিনি কিন্তু শেবাগকে দেখছি! কী পেল্গয়ার! ওয়ানডে ম্যাচে ২১৯ রান করা তো প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।' তবে সবচেয়ে মজার টুইট করেছেন বোধহয় পিটারসেন। রীতিমতো লাইন অব কন্ট্রোল ভেঙে তখন বেরিয়ে যাচ্ছেন শেবাগ। চলমান সেই ইনিংস দেখতে দেখতে কেপি টুইটারে লিখছেন_ 'আপনি যদি ক্রিকেট ভালোবেসে থাকেন, তা হলে এখনই টিভি অন করুন আর একজন জিনিয়াসকে ব্যাট করতে দেখুন। শেবাগ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধ্বংস করছে... বিশ্বরেকর্ড আসছে।'
ইনিংসে দু'বার রান আউটের সুযোগ দিয়েছিলেন। দু'বার ক্যাচও তোলেন। ৩৭.৫ ওভারে পেছনের দিকে দৌড়ে গিয়ে এক্সট্রা কাভারে যা অবিশ্বাস্যভাবে ফেলে দেন ড্যারেন স্যামি। ১৭০ রানে তখন অপরাজিত শেবাগ। পরে বলেছেন, 'ডাবল সেঞ্চুরির কথা ভেবে তো আর মাঠে নামিনি। তবে জানতাম একটু ধৈর্য ধরতে পারলে বড় রান আসবে। এত ভালো উইকেট আর আউটফিল্ড। ব্যাটিং পাওয়ার প্লের সময়ই মনে হচ্ছিল এবার ডাবল সেঞ্চুরিটা হয়ে যেতে পারে। আর স্যামি যখন ক্যাচটা ফেলল, তখন বুঝলাম ঈশ্বর আমার সঙ্গে আছেন। ডাবলটা মনে হয় হয়েই যাবে।'

No comments

Powered by Blogger.