ইউরো জোন কি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে? by গাজীউল হাসান খান

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে জটিল ঋণগত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে গ্রিস ও ইতালির কত সময় লাগবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে আবার চরম সংকটে পড়তে যাচ্ছে স্পেন, পর্তুগালসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আরো কয়েকটি সদস্যরাষ্ট্র। এতে শেষ পর্যন্ত মনে হয় বাদ পড়বে না ইইউয়ের মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো জোনের অন্যতম সদস্য ফ্রান্স, এমনকি ইউরোর বাইরের সদস্য ব্রিটেনও। এটি শুধু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।


ফলে এক চরম মন্দাবস্থা কালো মেঘের মতো ইউরোপজুড়ে ঘনিয়ে আসছে, যা কাটতে এক দশকের মতো সময় লেগে যেতে পারে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। এর ফলে ইইউয়ের মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো জোন যেমন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি চরম অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানি সেটা চায় না। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর তারা যেকোনো মূল্যে নিজের এবং ইউরোপের স্বার্থে ইউরো জোনকে টিকিয়ে রাখতে চায়। তা না হলে যে পরিমাণ অর্থ তারা ইউরোপের অন্যান্য সদস্যদেশে বিনিয়োগ করেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জার্মানি নিজেই। তা ছাড়া যে ব্রিটেন ইউরো জোনের সদস্য নয়, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদও রাখতে চায়নি, তারাও এ মুহূর্তে ইউরোপীয় ব্যবস্থা কিংবা বাজার ছেড়ে যেতে চায় না। কারণ ব্রিটিশ ব্যাংকগুলোও প্রচুর পরিমাণ অর্থ ইউরোপের বিভিন্ন সরকারি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় লগি্ন করে রেখেছে। এই মুহূর্তে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে হলে ব্রিটেন প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়বে। বরং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রকে 'বেইল আউট' বা দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি আরো কিছু অর্থ লগি্ন করতে হয়, তাহলে সীমিতভাবে তাও করতে হবে ইতিমধ্যে লগি্নকৃত অর্থ আদায় করে আনতে। কিন্তু বর্তমানে ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকার নিজেরাই এগিয়ে যাচ্ছে এক চরম সংকটের দিকে, যা তাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী মন্দাবস্থা ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে অবস্থা কাটিয়ে ওঠার ওপরই নির্ভর করছে ইউরো জোন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের টিকে থাকার সম্ভাবনা বা ভবিষ্যৎ।
আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও স্পেনের প্রথম দফা ঋণ সংকটের পর সাম্প্রতিক সময়ের সবেচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল 'গ্রিক বেইল আউট'। তারপর দেখা দিয়েছে ইতালির ঋণ সমস্যা, যা গ্রিসের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ফলে একে একে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপেন্দ্রেও এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সেসব দেশের রাজনীতিবিদ নয়, দুজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। গ্রিসে জর্জ পাপাডেমাস এবং ইতালিতে মারিও মন্টি। জনমনে এবং দেশের অর্থনীতিতে আস্থার ভার ও সংকট কাটিয়ে ওঠার মতো পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নবাগতরা সীমাহীন ঋণ লাঘবের জন্য ইতিমধ্যে আর্থসামাজিক জীবনে কৃচ্ছ্রসাধনমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা ঘোষণা করেছেন। তা ছাড়া মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধি, সরকারি পর্যায়ে বেতন বৃদ্ধি স্থগিত এবং পেনশনের বয়সসীমা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন নতুন (ছোট ও মাঝারি) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে করের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মোটা লভ্যাংশের ওপরও বর্ধিত হারে করারোপের চিন্তাভাবনা করছেন তাঁরা। ইতালির সিনেট ও সংসদ পর্যায়ে সে ব্যবস্থাগুলো ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে। ইতালির নয়া প্রধানমন্ত্রী মারিও মন্টি যদি সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে আশা করা যায়, ২০১৪ সালের মধ্যে ইতালিতে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার সঞ্চয়ের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থায় পেঁৗছা সম্ভব হবে। ইতালি যদি সে ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সাধন করতে না পারে, তাহলে ইউরো জোন বা ইউরো মুদ্রাব্যবস্থার ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে। তাতে ইউরো জোন ভেঙে যেতে পারে এবং ইউরোপ আবার আগের অসংগঠিত বা বিচ্ছিন্ন অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। তাতে নতুন পর্যায়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর প্রভাব অবশ্যই এশিয়া ও আমেরিকায় পড়তে বাধ্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে বর্তমানে ১৭টি রয়েছে ইউরো জোন বা ইউরো মুদ্রাব্যবস্থার অধীনে। এদের মধ্যে পর্তুগাল, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস ও ইতালি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে (সদস্যরা) ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থা চালু করতে পারে। তাতে ইউরো জোন ও তার উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানিব্যবস্থা বিঘি্নত হওয়ার চরম আশঙ্কা রয়েছে। উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে ইতালির ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। তা ছাড়া সোনা রিজার্ভের ক্ষেত্রে তারা বিশ্বের তৃতীয় স্থানে রয়েছে বলে জানা গেছে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকেও বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক ছিল ইউরোপ। উপনিবেশবাদী দেশ হিসেবে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশই প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা, লগি্নপুঁজিতে উচ্চ সুদের হার, উত্তরোত্তর ঋণ সমস্যা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে উচ্চ মজুরি ও উচ্চতর উৎপাদন খরচের জন্য ইউরোপ ক্রমেই বাজার হারাতে থাকে। অথচ জীবনযাত্রার ব্যয় ও মান ক্রমে ওপরের দিকেই ধাবিত হয়েছে, কমেনি। বর্তমান অবস্থায় অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরো জোনের দুর্বল সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে টেনে তোলার ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এই ব্যাংকের সে পরিমাণ অর্থ না থাকলে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) শরণাপন্ন হওয়া উচিত বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ব্রিটিশ বিজনেস সেক্রেটারি ভিনসেন্ট ক্যাবল মনে করেন, বর্তমান ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে পরিমাণ অর্থ মজুদ রয়েছে, তা পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে গ্রিস এবং বিশেষ করে ইতালিকে সংকট থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। তা ছাড়া মুদ্রাস্ফীতির দিকে লক্ষ রেখে যথাসম্ভব ইউরো ছাপিয়েও অর্থ জোগান দেওয়া অসম্ভব হবে না। পরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে ইতিমধ্যে আয়ারল্যান্ডের রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে সন্তোষজনকভাবে। তেমনি সুচিন্তিতভাবে ব্যবস্থা নিলে ইতালিও বর্তমান সংকট থেকে মুক্ত হতে পারে। তবে সব কিছুই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কষ্টসাধ্য হলেও বর্তমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ইউরো সমর্থক অর্থনীতিবিদরা জার্মানিসহ কয়েকটি সচ্ছল অর্থনীতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তা না হলে ইউরো জোনে ধস নামলে কিংবা শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ইউরোপে উৎপাদিত পণ্যের জন্য বাজার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। ব্রিটেনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ অর্থনীতি তার ২০০৮ সালের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। তা ছাড়া ইউনিয়নের দুর্বল দেশগুলো শেষ পর্যন্ত মহামন্দার কারণে ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলে ব্রিটেনের আরো অনেক বেশি ক্ষতি হবে। ঋণের অর্থ ফেরত না পাওয়ার কারণে দু-একটি ব্রিটিশ ব্যাংক বন্ধও হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, গ্রিস ও ইতালির পর স্পেনের পরবর্তী ঋণ সংকট ও ঘাটতি মোকাবিলায় বর্তমানে জার্মানি এবং বিশেষ করে ফ্রান্স নিজেরাই এখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আগের তুলনায় এখন ঋণ করার ব্যয়ও তিন গুণ বেড়ে গেছে। ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ নিয়েও এখন নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাই গত চার মাসে ফ্রান্সকে দুটি জরুরি বাজেট ঘোষণা করে ঋণ ও ঘাটতি লাঘবের উদ্দেশ্যে আরো কৃচ্ছ্রসাধনের ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। অন্যদিকে ইউরো জোনের বাইরে থাকা ব্রিটেনকে লেবার-পরবর্তী কোয়ালিশন সরকার গঠনের পর থেকেই তার কল্যাণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন আর্থসামাজিক সেবামূলক খাতে কঠোর হাতে ব্যয় সংকোচ করতে হয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন অনুদান কিংবা সহায়তা প্রদান গুটিয়ে আনতে হয়েছে। যুবগোষ্ঠীর জন্য প্রণীত বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্পের বরাদ্দ কেটে দিতে হয়েছে। তবে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আবাসিক নির্মাণকাজ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন কথিত মন্দার আঘাত লাঘব করার ইস্যুটি সামনে রেখে। বর্তমানে ব্রিটেনে ২ দশমিক ৬২ মিলিয়ন বেকারের মধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি রয়েছে যুবগোষ্ঠীর সদস্য। ২০ বছরের মধ্যে এমন পরিস্থিতি আর কখনো দেখা দেয়নি। সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে বাড়িঘরের মর্টগেজ পরিশোধ, ব্যবসার জন্য সুদের নিম্নহার নির্ধারণ এবং অর্থনীতির স্থিতাবস্থা ধরে রাখাই সংকট কাটিয়ে ওঠার নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন অসবর্ন।
পাশাপাশি আবাসিক বিনির্মাণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসাকে উৎসাহী করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি ক্ষেত্রে গবেষণাসহ বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন এবং অসবর্ন বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় আইএমএফের উচিত প্রতিটি সমস্যাসংকুল দেশের চাহিদা অনুপাতে তাদের পাশে দাঁড়ানো। সে লক্ষ্যেই ১৯৪৪ সালে ব্রিটেনসহ অন্যরা আইএমএফ গঠন করেছিল। সদস্যদেশগুলোর সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা করতে হবে বলে অসবর্ন সুপারিশ করেছেন। তা ছাড়া বর্তমানে ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা। তিনি বলেছেন, ইইউয়ের এখন বিশেষ কর্তব্য হবে, একটি খোলাবাজার ও বৃহত্তরভাবে মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত করা; একটি 'একক বাজার' শক্তিশালী করে তোলা। অসবর্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর প্রথমবারের মতো স্থায়ী লেভি আরোপ করেছেন এবং ধনীদের বিভিন্নভাবে কর না দেওয়া এবং ফাঁকি দেওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ইউরোপকে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাতে এক নতুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে উঠবে বলে তাঁর বিশ্বাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আজ সেটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে অর্থনৈতিক পণ্ডিতরা মনে করেন।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.