শান্তিচুক্তির ১৪ বছর-দাবি আদায়ে পাহাড়ে টানা আন্দোলনের প্রস্তুতি by বিপ্লব রহমান

পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বলেছেন, শান্তিচুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে ২০১২ সাল হবে লাগাতার কর্মসূচির বছর। তিনি বলেন, শান্তিচুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনাসহ (রোডম্যাপ) ১৯ দফা দাবি আদায়ে আগামী মার্চে পাহাড়ে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। একই দাবিতে জানুয়ারি থেকে গণসংযোগ, গণসমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি চলবে।


মার্চে মহাসমাবেশের পর লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। আজ ২ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ পূর্তিকে সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে তিনি এসব কথা বলেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে এই প্রথম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে মহাসমাবেশসহ লাগাতার কর্মসূচির কথা ঘোষণা দেওয়া হলো।
সন্তু লারমা জানান, এরই মধ্যে মহাসমাবেশসহ আন্দোলনের বিস্তারিত পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুবিধাজনক কোনো স্থানে এই মহাসমাবেশ হবে। মহাসমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হবে আরো কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ শুক্রবার শান্তিচুক্তির ১৪তম বর্ষপূর্তির দিনে সকালে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় এবং বিকেলে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
১৯৯৭ সালের এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির ফলে পাহাড়ি বিদ্রোহী গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রায় দুই দশকের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের অবসান হয়। চুক্তির আওতায় প্রায় দুই হাজার শান্তিবাহিনীর সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ভারতের ত্রিপুরা থেকে শরণার্থী জীবনের গ্লানি ঘুচিয়ে দেশে ফেরে প্রায় ৬০ হাজার পাহাড়ি।
তবে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হচ্ছে, পাহাড়ি-বাঙালি জমিজমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে গঠিত ভূমি কমিশন অকার্যকর অবস্থায় থাকাসহ শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তগুলো এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। অন্যদিকে সরকার পক্ষ বরাবরই দাবি করে আসছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা কালের কণ্ঠকে বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। পার্বত্য সমস্যা সমাধানে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যা এখন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। কোনো সরকারই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাবে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হতে পারছে না। আমরা সরকারের সঙ্গে বরাবরই যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছি। কিন্তু গত ১৪ বছরেও তাদের মধ্যে এ জন্য কোনো তাগিদ দেখিনি।
সন্তু লারমা বলেন, সরকারের মন্ত্রী-আমলারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে চুক্তি বাস্তবায়নের সদিচ্ছার বুলি আউড়িয়ে চলেছেন। আবার কিছু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের চরম ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে তারা 'চুক্তি বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, চুক্তি বাস্তবায়নে জনসংহতি সমিতি সহযোগিতা করছে না, পাহাড়ি নেতারা এ অঞ্চলের উন্নয়ন চান না' ইত্যাদি বানোয়াট, মনগড়া ও উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে চলেছেন।
সন্তু লারমা অভিযোগ করে বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ের মৌলিক কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। চুক্তিপূর্ব অবস্থার মতো এখনো সেখানে সব ক্ষেত্রে সেনা কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। জুম্ম (পাহাড়ি) জনগণের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন-নিপীড়ন এখনো আগের মতো অব্যাহত রয়েছে। 'অপারেশন উত্তরণ'-এর ছত্রছায়ায় এবং প্রশাসনের সহায়তায় উগ্র সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী ও সেটলার বাঙালিরা জুম্মদের জায়গাজমি জবরদখল করার জন্য এখনো সামপ্রদায়িক হামলা চালাচ্ছে। সেনানিবাস সমপ্রসারণ, ইকো-পার্ক ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, উন্নয়নের নামে অস্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ভূমির ইজারা প্রদান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা ইত্যাদির নামে জায়গাজমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে জুম্মদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে।
অন্য দিকে শান্তিচুক্তির বেশির ভাগ শর্তই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবি করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। মন্ত্রণালয়ে পঞ্চম 'সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব' এবং চুক্তির ১৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সচিব বলেন, চুক্তির যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি, তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। তবে কত দিনে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে, তার দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। ভূমি কমিশন নিষ্ক্রিয় রয়েছে কি না_সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে নববিক্রম ত্রিপুরা বলেন, 'ভূমি কমিশন স্বাধীন, তাই কমিশন নিজের মতো কাজ করবে। ভূমি কমিশন সংস্কারের বিষয়ে আমরা বেশ কিছু প্রস্তাব পেয়েছি। এসব প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে।'
সচিব আরো জানান, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত ২৩৫টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্যগুলোও প্রত্যাহার করা হবে। তবে ঠিক কতগুলো সেনা ক্যাম্প সেখানে রয়েছে, তা তিনি জানাতে পারেননি।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি_ইউএনডিপি'র প্রকল্প পরিচালক হেনরি লার্সেন। এতে জানানো হয়, মন্ত্রণালয় ও ইউএনডিপি'র উদ্যোগে আগামী ৫ থেকে ৯ ডিসেম্বর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হবে। ৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।
এদিকে সন্তু লারমা বর্তমান ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে অপসারণ করে অন্য একজন উপযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে সেখানে নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশ অনুযায়ী 'পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১১ বিল খসড়া' অপরিবর্তিতভাবে পাস করার দাবি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ইউএনডিপির অর্থায়নে সরকারি উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় 'সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব' কর্মসূচিতে 'আদিবাসী' অভিধার বদলে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' নামক অভিধা ব্যবহার করা হয়। এর ফলে সারা দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
জনসংহতি সমিতির ১৯ দফা দাবির মধ্যে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর ও এ-সংক্রান্ত কার্যবিধিমালা চূড়ান্ত, তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের নির্বাচন বিধিমালা এবং ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, জেলা পরিষদগুলোর কাছে পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা দান, বন ও পরিবেশ, যুব উন্নয়ন, স্থানীয় পর্যটন ইত্যাদিসহ অন্যান্য অহস্তান্তরিত সব বিষয় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পরিষদের কাছে হস্তান্তর, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান ইত্যাদি রয়েছে।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান_এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন প্রায় পাঁচ হাজার ৯৩ বর্গমাইল, যা দেশের মূল ভূখণ্ডের ১০ ভাগ। সেখানে রয়েছে ১২টি ভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাস। পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে পাহাড়ের লোকসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। ১৯৮১ সালে পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ির সংখ্যা ছিল ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বাঙালি ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সেখানে ৫১ শতাংশ বাঙালি ও ৪৯ শতাংশ পাহাড়ির বসবাস। সর্বশেষ ২০০১ সালের হিসাবে অনুপাতটি হচ্ছে ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৫১ শতাংশ পাহাড়ি।

No comments

Powered by Blogger.