শান্তিচুক্তির ১৪তম বার্ষিকী আজ-পাহাড়ে শান্তি নেই by রাশেদ মেহেদী ও সত্রং চাকমা

শান্তির আবরণে ঢাকা পাহাড়ে একদিকে চলছে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস, রক্তপাত; অন্যদিকে দূরত্ব বাড়ছে পাহাড়ি-বাঙালিদেরও। চৌদ্দ বছরেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। কাগজে-কলমে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। নির্বাচিত নেতৃত্বের বদলে নানা কৌশলে পাহাড়ি এলাকার প্রশাসনে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে তিনটি জেলার জেলা প্রশাসকদেরই। সময় যত যাচ্ছে, পাহাড় তত বেশি অশান্ত


হচ্ছে। আর এ প্রেক্ষাপটেই এ বছর পালিত হচ্ছে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির চৌদ্দতম বার্ষিকী। পার্বত্য জনসংহতির সভাপতি সন্তু লারমা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বর্তমান সরকারের
বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। অপর পাহাড়ি সংগঠন ইউপিডিএফ বলছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নয়, পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ছাড়া পাহাড়ে শান্তি আসবে না। সরকার পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার দাবি করেছেন, একটি-দুটি ছাড়া শান্তিচুক্তির আর সবকিছুই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারসহ ভূমি সমস্যার সমাধানেও বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে।
ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির চৌদ্দ বছর
দীর্ঘ প্রায় ২৩ বছর ধরে চলা সংঘাত নিরসনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনপদে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল শান্তিচুক্তি। বাংলাদেশ সরকার ও পাহাড়ি অঞ্চলের বৃহত্তম সংগঠন জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পাহাড়ি জনপদের নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
এর আগে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পাহাড়ি জনগণের জন্য স্বশাসনের দাবি তোলে। এক পর্যায়ে এ দাবি সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পাহাড়ি অঞ্চলে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাঙালিদের পুনর্বাসন কর্মসূচি শুরু করলে সংঘাত আরও চরমে ওঠে। প্রায় দুই যুগ ধরে পাহাড়ে চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি, রক্তপাত। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আধার পাহাড়ি অঞ্চল পরিচিতি পায় আতঙ্কের জনপদ হিসেবে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। গঠিত হয় তিনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হয়। গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড । ভয়াল জনপদের স্মৃতি মুছে ফেলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের আধার রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির প্রতিটি প্রান্ত। কিন্তু শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিনের মধ্যেই শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে জন্ম নেয় পাহাড়ের নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ। এই সংগঠনটি নতুন করে পাহাড়ে স্বশাসনের দাবি তোলে। সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলারও হুমকি দেয়। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ রাখা হয়। ফলে সংঘাত-সংকট ধীরে ধীরে আবারও প্রকট হতে থাকে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি আবারও পুনর্গঠন করা হয়। চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি ব্রিগেডসহ ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য প্রত্যাহার করে নেওয়া ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে লংগদু উপজেলায় দুটি, বরকল উপজেলায় দুটি ও রাঙামাটি সদর উপজেলায় একটি ক্যাম্প পুনর্বহাল করা হয়েছে।
শান্তিচুক্তির চৌদ্দ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া বক্তব্যে জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা সমকালকে বলেন, সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতারণা করছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হচ্ছে তারাই শান্তিচুক্তিবিরোধী। প্রধান দুটি সমস্যার মধ্যে ভূমি সমস্যার সমাধান হয়নি। এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা হয়নি। সেগুলো বাস্তবায়ন না হলে চুক্তির অন্য দিকগুলো বাস্তবায়নে নানাভাবে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। তাই সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা।
এ ব্যাপারে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের অন্যতম সমন্বয়ক প্রদীপন খীসা সমকালকে বলেন, আমরা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শুরুতেই বলেছিলাম, এ চুক্তি পাহাড়ে শান্তি আনবে না। তখন যারা শান্তিচুক্তি করেছিল, তারাই এখন বলছে চৌদ্দ বছরেও শান্তিচুক্তি শান্তি দিতে পারেনি। শান্তির জন্য দরকার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রশাসনিক ইউনিট বা সংস্থার কাছে পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতা দিতে হবে। এর সাংবিধানিক স্বীকৃতিও থাকতে হবে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনই কেবল পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, শান্তিচুক্তির একটি বা দুটি বিষয় বাদে অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ গঠন, ১২ হাজার ২২২টি ভারত প্রত্যাগত পরিবার, ১ হাজার ৯শ' শান্তিবাহিনীর সদস্যকে পুর্নবাসন করা হয়েছে। এ ছাড়া শান্তিবাহিনী সদস্যদের অধিকাংশ মামলা প্রত্যাহারসহ তাদের চাকরি দেওয়া হয়েছে ও ভর্তির ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশা, আবারও সংঘাত
পাহাড়ে সংঘাত বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার নেতারা দায়ী করেছেন শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াকে। তাদের অভিমত, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়ি এলাকার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। আর এ হতাশা থেকেই নতুন সংঘাতের জন্ম হচ্ছে। এ হতাশাকে পুঁজি করে বর্তমানে পাহাড়ি এলাকায় একাধিক প্রভাবশালী সংগঠন নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। মূলত জনসংহতি সমিতি এবং ইউপিডিএফের মধ্যে মূল সংঘাত চলছে। ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা সুধাসিন্ধু খীসা ও রূপায়ন দেওয়ানের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) হিসেবে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জনসংহতি সমিতি এমএন লারমার গ্রুপটি বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ নেতৃত্বাধীন এলাকায় রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে এখন দুই সংগঠনের বদলে তিনটি পাহাড়ি দলের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত চরম আকারে পেঁৗছেছে। একের পর এক ঘটছে বন্দুকযুদ্ধ আর প্রাণহানি। এসব প্রাণহানির ঘটনায় চরম উৎকণ্ঠায় ভুগছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।
পাহাড়ে সংঘাত-দ্বন্দ্বের ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির রাঙামাটির সাধারণ সম্পাদক রকি চাকমা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য নাগরিক কমিটি দুই দলের সংঘাত বন্ধ ও ঐক্যের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা হচ্ছে। বিশেষ করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার ও ভূমি অধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এমএন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক বিজয় কেতন চাকমা যে কোনো সন্ত্রাস-সংঘাত আমানবিক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও বোঝাপোড়া থাকতে হবে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তবে যে রাজনৈতিক দল অন্যের দ্বারা চালিত ও পরিচালিত হয় সে রাজনৈতিক দলের ভাগ্য সুদূরপরাহত। তাই আজ যারা সংঘাতের পথে যাচ্ছে তারা ভুল পথে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা জানান, পার্বত্য জনগণ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত চায় না, শান্তি চায়। কারণ সংঘাতের মাধ্যমে কোনো কিছুই সমাধান সম্ভব নয়।
দীঘিনালা উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি নবকমল চাকমা বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়ে চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম; কিন্তু ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত সে আশা হতাশায় পরিণত করেছে। তাই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক স্বার্থে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.