ক্রিকেটার আফ্রিদি, 'ক্যারেক্টার' আফ্রিদি by নোমান মোহাম্মদ

কান পাতলেই শোনা যায় ক্রিকেট থেকে 'ক্যারেক্টার' হারিয়ে যাওয়ার হাহাকার। মুষ্টিমেয় যে কজন এর জাজ্বল্য ব্যতিক্রম, শহীদ আফ্রিদির অবস্থান সেই সারির সামনের দিকেই। ডাকাবুকো ব্যাটিং, জানপ্রাণ বাজি রাখা বোলিং, উইকেট উদ্যাপনের নিজস্ব স্টাইল_সঙ্গে যোগ করুন, কোচ, সাবেক অধিনায়ক-খেলোয়াড় ও ক্রিকেট প্রশাসকদের সঙ্গে তাঁর অম্লমধুর সম্পর্কের ইতিহাস। বর্ণিল চরিত্র বলতে যা বোঝায় আর কি!


মাঠের বাইরের এ আফ্রিদিই হাসি-খুশি, আমুদে, ফুর্তিবাজ এক চরিত্র। তাঁর সংবাদ সম্মেলনগুলোও তাই একঘেয়ে হয় না। তাত্তি্বক কিছু কথায় আটকে না থেকে মাঝেমধ্যেই সীমানা পেরিয়ে যান 'বুম বুম'। কালই যেমনটা করে গেলেন ৫ উইকেট ও অপরাজিত ২৪ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার পর। বাংলাদেশের ৯১ রান টপকাতে পাকিস্তানের কতটা কষ্ট হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে যেমন দুম করে বলে বসলেন, 'দে বোলড ওয়েল...ভালোবাসি।' হ্যাঁ, শেষ শব্দটি খাঁটি বাংলায়। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে যাওয়ার সময়ও বার দুয়েক মাথা নাড়তে নাড়তে স্ফূর্তির মতো করে বলে গেলেন, 'ভালোবাসি...ভালোবাসি!'
আফ্রিদি মজা করেছেন। তাচ্ছিল্য যে করেননি, তাই তো ঢের। একমাত্র টোয়েন্টি টোয়েন্টির পর প্রথম ওয়ানডেতেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যে পা কাঁপাকাঁপি, সেটি আসলে উপকরণ জোগাচ্ছে হাসিরই। সেটি আরো বেশি করে, যখন মনে পড়বে এই পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রতি ম্যাচের আগে জয়ের ছবি আঁকছিলেন অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক, কোচ। অন্তত মাইক্রোফোনের সামনে বসে বলে গিয়েছিলেন তেমনটা।
তবে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে আফ্রিদির। নিজেকে ফেরানোর অভিযান নিয়েই তাঁর যত ব্যস্ততা। স্বঘোষিত অবসর থেকে ফিরেছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে। সেখানে দুরন্ত পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা এখানে ধরে রাখাই তাঁর মিশন। এখন পর্যন্ত সাফল্যের কক্ষপথেই আছেন আফ্রিদি। টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে ৪ ওভারে ১৫ রান দিয়ে ১ উইকেট, আর কাল তো ৬.৩-০-২৩-৫ বোলিং ফিগারের পর ব্যাট হাতে দলের বিপদের মুহূর্তে ২৩ বলে অপরাজিত ২৪! এমন আফ্রিদিকেই তো চায় পাকিস্তান।
অথচ কিছুদিন আগেই তিনি ছিলেন 'অবসর'-এ। ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দলের অধিনায়ক ছিলেন আফ্রিদি। মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন কোচ ওয়াকার ইউনিসের সঙ্গে। পিসিবি কেড়ে নেয় তাঁর অধিনায়কত্ব। আফ্রিদি ঘোষণা দেন শর্তসাপেক্ষ-অবসরের। বলেছিলেন, পিসিবিতে পরিবর্তন এলেই তিনি কেবল ফিরতে পারেন। ঠিকই পিসিবি চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইজাজ বাট সরে দাঁড়ানোর পর ফেরেন তিনি। আর ফিরেছেন রাজার মতোই সাড়ম্বরে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের পর বাংলাদেশে এসেও দেখাচ্ছেন দুরন্ত ফর্ম। সব মিলিয়ে এ বছর ২৫ ম্যাচে ৮৬১ রান দিয়ে নিয়েছেন ৪৫ উইকেট। এ বছর ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারির তালিকায় আফ্রিদির ওপরে কেবল লাসিথ মালিঙ্গা। ২৪ ম্যাচে ৪৮ উইকেট লঙ্কান এ পেসারের।
বাংলাদেশের বিপক্ষে আফ্রিদির ১৬ ম্যাচে শিকার ২৯ উইকেট। বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বৈরথে সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর। এ বছর ইনিংসে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো ৫ উইকেট পেলেন এই লেগস্পিনার। সব মিলিয়ে যা ক্যারিয়ারে সপ্তম। পাকিস্তানিদের মধ্যে এখানে তাঁর চেয়ে এগিয়ে কেবল ওয়াকার ইউনিস (১৩ বার)। ছয়বার করে নেওয়া দুই কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম ও সাকলায়েন মুশতাককে কাল ছাড়িয়ে গেলেন আফ্রিদি। ওয়ানডেতে এ নিয়ে ২৭তমবারের মতো ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেন তিনি। এখানেও পাকিস্তানিদের মধ্যে তাঁর ওপরে কেবল একজন, সাঈদ আনোয়ার (২৮)।
১০ ওভারে ২ উইকেটে বাংলাদেশের রান যখন ২৬, কাল তখন বোলিংয়ে আসেন আফ্রিদি। প্রথম ওভারেই মুশফিকের বিপক্ষে জোরালো এলবিডাবি্লউর আবেদন করেছিলেন। আম্পায়ার কানে তোলেননি। পরের ওভারে লাফিয়ে ওঠা বলে শাহরিয়ার নাফিস কাট করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে। দুই বল পর মাহমুদ উল্লাহর ব্যাট ছুঁয়ে উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে জমা পড়ে বল। পরের ওভার দুটোতে আর উইকেট দেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। আফ্রিদির প্রথম স্পেল তাই রইল ৪-০-১৪-২। ২৭তম ওভারে ফিরলেন আবার। টানা তিন ওভারে তিন উইকেট নিয়ে গুটিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ইনিংসের। কাট করতে গিয়ে আউট হন সাকিব, ফরহাদ রেজা এলবিডাবি্লউ আর শফিউলের ব্যাটের ভেতরের কানায় লাগা বল কিপারের গ্লাভসে গেলে ৫ উইকেট হয়ে যায় আফ্রিদির। এরপর যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, ৬৩ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান তখন খানিকটা অনিশ্চয়তার দোলায়। আফ্রিদির ব্যাটের ঝড়ে কোথায় উড়ে গেল তা!
ক্যারিয়ারের এটি সহজতম ৫ উইকেট কিনা, সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নও উঠেছিল। আফ্রিদি তাতে সায় দিলেন না, 'ম্যাচের আগে তো এটি ভাবা যায় না যে পাঁচ উইকেট পাব। তবে ভালো বোলিং করার আত্মবিশ্বাস ছিল। সব ম্যাচে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা থাকে। এখানেও ছিল।' উইকেট থেকে যে সাহায্য পেয়েছেন, সেটি অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি। তবে এটি আদর্শ ওয়ানডে উইকেট কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি সরাসরি, 'আমার তো এসব বলা ঠিক না। এটুকু বলতে পারি, সমর্থকরা মাঠে আসে কিছু রান দেখতে। এই প্রশ্ন তাই সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞেস করলেই ভালো হয়।' মাঝের স্বেচ্ছা-অবসর কাটিয়ে ফেরার পর নিজেকে প্রমাণের যে তাগিদ ছিল, বলেছেন তাও, 'এ সময়টাতে আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। ফিরে আসার পর আমার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। সমর্থকরা আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করছিল অনেক। আমি শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ সিরিজে তাই খুব মনোযোগ দিয়ে ক্রিকেট খেলছি।'
এর ফল যে কী, তা কিছুদিন আগে টের পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশ!

No comments

Powered by Blogger.